ঈদের আগে অধিকাংশ অফিস-আদালতে বৃহস্পতিবার ছিল শেষ কার্যদিবস, ফলে অনেকে এদিন বিকালেই বাড়ির পথ ধরেন। এতে দুপুরের পর রাজধানীর ট্রেন স্টেশন এবং বাস ও লঞ্চ টার্মিনালমুখে ভিড় বাড়লেও রাত নাগাদ তা কমতে দেখা যায়।
এবার ঈদের সময় কোটি মানুষ ঢাকা ছাড়বে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক জরিপের ভিত্তিতে জানালেও ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় পথের দুর্ভোগ অন্য বারের মতো হবে না বলে অনেকেই ধারণা করছিলেন।
বৃহস্পতিবার ঈদযাত্রার শুরুতে বাড়িমুখো যাত্রীদের তেমন দুর্ভোগের কথা শোনা যায়নি।
ঈদের সময় প্রতিদিন ঢাকা ছাড়বে ৩০ লাখ মানুষ: জরিপ
আগের দিনের ট্রেনে বিশেষ করে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের ট্রেনগুলো আগের দিনের মতো দেরিতে ছেড়েছে। বাস টার্মিনালগুলোতে তেমন ভিড় দেখা যায়নি, তবে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ ছিল। লঞ্চগুলো যাত্রীভরতি করেই সদরঘাট ছেড়েছে।
এবার সরকার নির্ধারিত ঈদুল ফিতরের ছুটি ২ থেকে ৪ মে, অর্থাৎ সোম থেকে বুধবার। কিন্তু তার আগে ১ মে রোববার মে দিবসের ছুটি, তার আগের দুদিন আবার সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে গণপরিবহনে বাড়ি যাওয়ার চাপ একদিনে না পড়ে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত যথাসময়েই গাবতলী ও মহাখালী থেকে উত্তরাঞ্চল ও ময়মনসিংহগামী বাসগুলোকে টার্মিনাল ছাড়তে দেখা গেছে।
দুপুরের পর থেকেই ভিড় বাড়তে শুরু করে গাবতলী বাস টার্মিনাল, কল্যাণপুর এবং মাজার রোড এলাকার বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টারে।
শাহজাদপুর ট্রাভেলসের যাত্রী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছুটি শুরু কাল থেকে। আজ অফিসের কাজ শেষ করে একটু আগে বের হয়ে গেছি। সামনে সাত দিনের ছুটি। পাবনা যাব। ছয় ঘণ্টার মতো লাগে। জ্যাম থাকলে হয়তো আরও কিছুটা বেশি সময় লাগবে।”
ইশতিয়াক আগে টিকেট কিনে রাখলেও যারা তা পাননি, তারা দূরপাল্লার বাসের টিকেট না পেয়ে পাটুরিয়া পর্যন্ত বাসে যাচ্ছিলেন। সেখান থেকে লঞ্চে পদ্মা পার হয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে যাবেন।

শিমুলিয়া ঘাটে এই ভিড় ফেরিতে উঠতে।
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার বাসিন্দা ঢাকার একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী গোলাম হোসেন গাবতলী থেকে পাটুরিয়া যেতে সেলফি পরিবহনের একটি বাসে উঠেছিলেন।
তিনি অভিযোগ করেন, পাটুরিয়াগামী এই বাসের ভাড়া ১৫০ টাকা। কিন্তু দুপুরের পর থেকে ২০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
“এরা ঈদের সময় সুযোগ পেয়েই বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। যেহেতু যেতেই হবে এজন্য মানুষকে জিম্মি করে।”
দেখা গেছে, সেলফি পরিবহনের সব বাসেই অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করা হচ্ছে।
বাসে বেশি ভাড়া নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সেলফি পরিবহনের বিভিন্ন বাসে যাত্রী তোলার কাজ তদারকের দায়িত্বে থাকা নিরঞ্জন দাস নামে একজন বলেন, “যাওয়ার সময় যাত্রী ঠিকই হয়। কিন্তু আসার সময় খালি গাড়ি আসে। এখন দুইশ টাকা ভাড়া। সন্ধ্যার পর থেকে তিনশ টাকা হইয়া যাইব। কিছুই করার নাই।”
গাবতলীর হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে দেখা গেছে যাত্রীদের মোটামুটি ভিড়, সব যাত্রীর টিকেটই আগে কাটা। তারা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল থেকেই বাস ছেড়ে যাচ্ছে। দুপুরের পর যাত্রীদের চাপ বেশি হয়েছে। রাতে তা আরও বাড়বে।”
রংপুর যেতে হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে বাসের অপেক্ষায় ছিলেন ফারদিন খান। ঢাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানার এই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঈদের ছুটি পেয়েছেন দেরিতে। এ কারণে টিকেট কিনতে পারেননি। বৃহস্পতিবার যাওয়ার আগে কাউন্টার থেকে টিকেট কিনতে এসেছেন। তবে পাননি।
“চেষ্টা করে দেখি টিকেট পাই কি না। হানিফের টিকেট না পেলে অন্য পরিবহনে চেষ্টা করবো। না পেলে শুক্রবার বা শনিবার যেতে হবে।”
মোটরসাইকেলে চড়ে পাবনার উদ্দেশে রওনা হতেদেখা গেল দুই বন্ধুকে। বেলা সাড়ে ৩টায় টেকনিক্যাল মোড়ে তাদের সঙ্গে কথা হয়।
তাদের একজন সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বাসে ভিড় এড়াতে দুই বন্ধু মোটরসাইকেলে বাড়ি যাচ্ছেন।
“ঢাকা থেকে সাভার হয়ে আরিচা যাব। সেখান থেকে নগরবাড়ী হয়ে বাড়িতে।”
রাত পৌনে ১২টার দিকে গিয়ে শ্যামলী ও কল্যাণপুর এলাকার বাস কাউন্টারগুলোতে যাত্রীদের তেমন ভিড় দেখা যায়নি। তবে শ্যামলী থেকে গাবতলীমুখী রাস্তাটা যানজটে প্রায় আটকে ছিল।

ঈদে দক্ষিণবঙ্গমুখী মানুষের ঢলে লঞ্চের ডেক পরিপূর্ণ। বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকার সদরঘাট ছেড়ে যাওয়া অধিকাংশ লঞ্চেই ছিল এমন অবস্থা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
ঈদের চার দিন বাকি থাকলেও সদরঘাট থেকে ঈদ করতে বাড়ি যাওয়ার যাত্রীর যেমন চাপ থাকার কথা ছিল, তেমন ছিল না বৃহস্পতিবার।
যাত্রীর চাপ অন্য বারের চেয়ে কম জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক এ বি এস মাহমুদ বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ছেড়ে যায় ৬০টি লঞ্চ।
এমভি ফারহান লঞ্চের কর্মী মো. ফারুক বলেন, “শবে কদরের রাত হওয়ায় আজ যাত্রীর চাপ কম। কাল থেকে বাড়বে।”
সদরঘাট থেকে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ৮০টির মত লঞ্চ ছেড়ে গেলেও ঈদযাত্রায় প্রতিদিন ছেড়ে যায় ২০০টির মতো লঞ্চ। এর মধ্যে চাঁদপুরসহ নিকট গন্তব্যের লঞ্চগুলো সকালে ছাড়ে, বিকালে ছাড়ে বরিশাল অঞ্চলের লঞ্চ।

কমলাপুর স্টেশন থেকে বুধবার ট্রেনগুলো দেরি করে ছাড়ছিল, বৃহস্পতিবারও একই চিত্র দেখা যায়।
সকাল ৭টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস। সেটিও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে কিছুটা দেরিতে ছাড়ে। নীলসাগর এক্সপ্রেসের ৬টা ৪০ নীলফামারীর উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও দুই ঘণ্টা পর সকাল ৮টা ৫২ মিনিটে এর যাত্রা শুরু হয়।
এছাড়া চট্টগ্রামগামী মহানগর এক্সপ্রেস সকাল ৬টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি স্টেশনেই আসে তার পরে। ৯টা ২০ মিনিটে উত্তরাঞ্চলগামী রংপুর এক্সপ্রেসের ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এটিরও ছিল একই অবস্থা। দেরি দেখে স্টেশনে থেমে থাকা মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে রংপুরের যাত্রীদের তুলে দেয় রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা এবং কমলাপুর স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি কিছুটা বিলম্বে ঢাকায় এসেছে। আবার ৩০ মিনিটের মধ্যেই আমরা ট্রেনটি গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে দিয়েছি। এই ট্রেনটিতে অন্য সময়ের চেয়ে দুই-তিন গুণ যাত্রীর চাপ রয়েছে। যেখানে আমাদের যাত্রাবিরতির দুই মিনিট স্টপেজ থাকার কথা, যাত্রী বেশী হওয়ার কারণে সেখানে বেশি সময় লাগছে।”
সিঙ্গেল লাইন হওয়ার কারণে রেল বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলের (খুলনা-রাজশাহী) ট্রেনগুলোর দেরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বৃহস্পতিবার ভোর থেকে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত থেকে মোট ১৮টি ট্রেন বিভিন্ন গন্তব্যে ঢাকা ছেড়ে যায়। এদিন সব মিলিয়ে ১১৮টি ট্রেন আসা- যাওয়া করবে বলে জানান আমিনুল।
ঈদের আগে শেষ কবে ট্রেন চলবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে। ২ মে যদি ঈদ হয়, তাহলে ১ তারিখ পর্যন্ত ট্রেন চলবে। ৩ তারিখ হলে দুই তারিখের ট্রেন চলবে। চাঁদ দেখার পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

দিনের প্রথম ভাগে খুব বেশি ভিড় দেখা যায়নি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। তবে সন্ধ্যা থেকে যাত্রীর চাপ বাড়তে থাকে। ঝুঁকি না নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই অনেকে স্টেশনে এসে উপস্থিত হন।
ঢাকা থেকে সকাল পৌনে ১১টায় কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করা কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসের জন্য সকাল ৮টা থেকেই স্টেশনে বসে অপেক্ষা করছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা তাফসির ইহতেশাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ঈদও বাড়িতে করতে পারিনি৷ এই ঈদে যদি বাড়িতে যেতে না পারি, তাহলে সেটা কষ্টের ব্যাপার হবে। আর বুধবার যেহেতু ট্রেনের শিডিউল নিয়ে ঝামেলা হয়েছে, তাই আর রিস্ক নিইনি।”
বেলা সোয়া ১১টায় কমলাপুর স্টেশনের ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাওয়া জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের যাত্রী শারমিন জাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদে সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চলে এসেছি। ট্রেনটা যে ভালোয় ভালোয় ধরতে পেরেছি, এতেই খুশি।”