ঈদ সামনে রেখে তৈরি পোশাক, জুতা ও গয়নার দোকানে ক্রেতার ভিড় বাড়ছে। শেষ সময়ে এসে ঢাকার সব দোকানেই উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে।
গত চার দিনে বিক্রি কিছুটা কমলেও শুক্রবার থেকে আবার চাপ বাড়ার প্রত্যাশা করছেন বিক্রেতারা। যদিও মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পর ক্রেতারা ‘হাত খুলে মার্কেট করবে এমন প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার হতাশাই শোনা গেল বেশিরভাগ দোকানির কণ্ঠে।
ব্যবসায়ীদের দাবি,, কোভিডের আগের ঈদের তুলনায় এবারের ঈদে বিক্রি অনেক কম।

রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স ও যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং মলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে গত শুক্র ও শনিবার ক্রেতা সমাগম বেশি থাকলেও রোববার কার্যদিবসে ভিড় কম দেখা গেছে।
সাধারণত বিপণিবিতানগুলোতে বেলা ২টা থেকে ক্রেতা সমাগম বাড়তে থাকে। ইফতারের আগে ভিড় কমলেও রাত ৮টা থেকে আবার বাড়ে।
বুধবার যমুনা ফিউচার পার্কে ক্রেতার খুব একটা ভিড় দেখা যায়নি। যারা কেনাকাটা করতে আসছেন, তাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। অনেকে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছেন।
এই মার্কেটে পোশাকের ব্র্যান্ড ‘নবরূপা’র শোরুমে বিভিন্ন পণ্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় চলছে। নারী, পুরুষ ও শিশুদের পোশাকের পাশাপাশি জুতা, জুয়েলারি, ব্যাগ ও খেলনা রয়েছে এখানে। বিক্রি বেশি হচ্ছে ছেলেদের পাঞ্জাবি ও শিশুদের পোশাক।

শাখা ব্যবস্থাপক সোহেল হোসেন বলেন,“মহামারীতে ২০২০ সালে বন্ধ থাকার পর পরের বছর ১৭ দিন যমুনা ফিউচার পার্ক খোলা ছিল। তাও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অনেকেই বের হয় নাই। অনলাইনে কেনাকাটা করেছে। সেই হিসেবে এবার বিক্রি ভাল। কিন্তু মহামারীর আগের বিক্রির তুলনা করলে এবার বিক্রি কম।
পোশাকের ব্র্যান্ড ‘রাইজ’-এর শাখা ব্যবস্থাপক ইনজামুল হকও জানালেন, “মহামারীর আগে রোজার এই সময়ে ক্রেতাদের ভিড়ে তাদের শোরুমে পা ফেলার মত জায়গা থাকত না। সে হিসেবে এ বছর ক্রেতা তেমন নেই।
“এখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বুঝে খরচ করছে। যেটা দরকার সেটার বাইরে কিনছে না। এ কারণে বিক্রি কম।”

এই মার্কেটে ‘আড়ং’য়ের শাখায় ক্রেতার ভিড় কিছুটা বেশি দেখা গেছে। অবশ্য বিক্রয় কর্মী মো. সুমনের দাবি, “অন্যান্য ঈদের তুলনায় এবার ক্রেতা কম।”
যমুনা ফিউচার পার্কের ‘প্লাস পয়েন্টে’ ছেলেদের শার্ট, পায়জামা, পাঞ্জাবি ও ডেনিম প্যান্ট বেশি বিক্রি হচ্ছে। আড়াই হাজার টাকার সীমার পোশাকেই ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি দেখা গেছে।
এবার ধারণার অর্ধেক ক্রেতাও পাননি জানিয়ে শাখা ব্যবস্থাপক জহিরুল ইসলাম বলেন, “গত বছর তো ১৭ দিন মার্কেট খোলা ছিল, সেই সময়েও মানুষ শপিং করেছে। এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণও কম। আমরা ভাবছিলাম হিউজ শপিং করবে মানুষ, অনেক প্রেসার পড়বে। কিন্তু এবার মানুষজনই নাই।”
বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সেও মঙ্গল ও বুধবার ক্রেতা সমাগম কম ছিল। যারা এসেছেন তাদের অনেককেই পরিবার নিয়ে কেনাকাটা করতে দেখা গেছে। কেনাকাটার মধ্যেই এই মার্কেটের দুটি ফ্লোরে মাদুর বিছিয়ে ক্রেতাদের দেখা গেছে ইফতার করতে।

এই মার্কেটে মেয়েদের জামা, পাঞ্জাবি, শার্ট, শিশুদের পোশাক ও জুতার ক্রেতাই বেশি।
শাড়ির ব্র্যান্ড ‘প্রাইডে’র ব্যবস্থাপক শামসুন্নাহার ডলি জানান, “স্বাভাবিক সময়ে ঈদে শুক্র-শনিবার তাদের ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হত, এবার তা নেমে এসেছে ১ লাখে।
“আগে যেই প্রোডাক্ট ছিল, এখনও একই। দামও কিন্তু বাড়ে নাই। অথচ বিক্রি নাই। অনেক আশা করেছিলাম ঈদের জন্য, কিন্তু কাস্টমার পাচ্ছি না আমরা।”
বসুন্ধরায় জুতার ব্র্যান্ড ‘অ্যাপেক্সে’ অন্যান্য দোকানের তুলনায় বেশি ভিড় দেখা গেছে। শুক্র-শনিবার বেশি ভিড় ছিল জানিয়ে স্টোর ম্যানেজার রুবেল মিয়া বলেন, “২০১৯ সালের চেয়ে কাস্টমার কম। আমরা ভাবছিলাম মানুষ ইচ্ছামত শপিং করবে এবার, কই দেখতেছি না তো।”

রোজার শুরুতে শিশু ও নারীদের জুতা বেশি চললেও এখন ছেলেদের স্যান্ডেল বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ঘর সাজানোর দোকানেও ক্রেতাদের আনাগোনা দেখা গেছে। ‘হোম টেক্সে’ এখন বিছানার চাদর বেশি বিক্রি হচ্ছে। তবে আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিকে দায় দিচ্ছেন এখানকার বিক্রয়কর্মী শহীদ আহমেদ, “দেশে যে অবস্থা, সবকিছুর দামই বেশি। মার্কেটে মানুষ আছে, কিন্তু কয়জনের হাতে ব্যাগ? চাহিদা থাকলেও দাম বেশি হওয়ায় অনেকে কিনতে পারছে না।”
যমুনা ফিউচার পার্ক ও বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের ক্রেতারা জানালেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমায় স্বস্তিতে কেনাকাটা করতে পারছেন।
বসুন্ধরার ‘অ্যাপেক্সে’ জুতা কিনতে আসা সৈয়দ ইকবাল হোসেন কোভিড সংক্রমণের আশঙ্কায় গত দুই বছর তেমন কেনাকাটা করেননি। “এখন সেটা নাই। তাই সবাই মিলে কেনাকাটা করতে এসেছি, অন্যান্যদের জন্যও কিনছি।”

এই মার্কেটের আড়ং থেকে বাবা ও ভাইয়ের জন্য পাঞ্জাবি কিনতে আসা রায়েরবাগের তাসনুভা ইসলাম মনে করেন, “কোভিডের কারণে সেভাবে দাম বাড়াতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। আসলে দামাদামি ব্যাপারটা ভালো লাগে না বলেই ফিক্সড প্রাইসের (এক দামের) দোকানে আসি। ঈদে আসলে প্রিয়জনদের কিনে দিতেই আনন্দ লাগে।”
তবে অভিজাত বিপণিবিতানগুলোর তুলনায় ঢাকার সাধারণ মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বেশি। বিক্রিও হচ্ছে ভালো। রোজার শুরু থেকেই ঈদের বিক্রি বাড়তে থাকে নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনী চক মার্কেটে।
তবে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে কিছু ক্রেতা হারানোর আক্ষেপ রয়েছে বিক্রেতাদের।

নিউ সুপার মার্কেটের পাঞ্জাবির দোকান ‘নবদিগন্তে’র মালিক জাহিদ মাহমুদের দাবি, “সংঘর্ষের পর থেকে নানান আশঙ্কায় ক্রেতারা আসতে চান কম।”
এরপরও বিক্রি ভাল জানিয়ে তিনি বলেন, “গত দুই বছর তো লাভের মুখ দেখতে পাইনি৷ এবার হচ্ছে। কিন্তু সেই আগের অবস্থা আর নাই।”
বিক্রেতারা জানালেন, এবার নারীদের ‘ঘারারা ড্রেস’ সব বয়সীদেরই আকৃষ্ট করছে। কামিজের সঙ্গে ঘের দেওয়া সালোয়ার ও ওড়না দিয়ে তৈরি এই পোশাক বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দরে।

চাঁদনি চক মার্কেটের ‘ফ্যাশন ওয়ার্ল্ড’ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় ঘারারা কিনেছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লুবাবা ফেরদাউস। ‘বন্ধুদের দেখে ফ্যাশনেবল এই ড্রেস কেনা’র কথা জানালেন তিনি।
এই দোকানের মালিক মোহাম্মদ জুয়েল জানান, “ঘারারার পর বেশি চলছে পাকিস্তানি লোন, আনস্টিচড থ্রি-পিস। ক্রেতারা সামর্থ্য অনুযায়ী কিনছেন। কিন্তু কোভিডের আগে যে পরিমানে বেচাবিক্রি হতো, সেটা এবার হয়নি।”
এসব মার্কেটের ক্রেতারা জানালেন ভিড় বেশি হওয়ায় তাদের বাড়তি সময় দিতে হচ্ছে, দাম বেশি চাওয়ায় দরাদরি করেও বেশি টাকা দিতে হচ্ছে।

বুধবার চার ঘণ্টা ঘুরে নিউ সুপার মার্কেটে দুটি জামা কিনতে পারেন মগবাজারের প্রাপ্তি ইসলাম। মায়ের সঙ্গে পরিবারের সবার ঈদ পোশাক কিনতে আসা এই নারী বলেন, “গত ঈদে অনলাইন থেকে শপিং করেছি। ভাবলাম এবার নিজে এসে কিনবো। পরিবারের সবার সাথে ঈদের খুশি ভাগ করে নিতে এই কষ্ট তো করতেই হবে।”
জামার সঙ্গে মিলিয়ে গয়না কিনতে এসে ধানমন্ডির সানজিদা খন্দকার জানালেন, “কোভিডের পর অনেক পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। আগে যে কানের দুলটা কিনেছি দেড়শো টাকা দিয়ে, এখন সেটা সাড়ে তিনশ’র নীচে পাওয়া যাচ্ছে না।”

নিউ মার্কেটের জুতার দোকানে ভিড় থাকলেও বিক্রি বেশি হচ্ছে রাস্তার পাশে হকারদের টুকরিবোঝাই জুতার দোকানগুলোতে। কম দামে কুর্তি, থ্রি-পিস, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, শার্টও পাওয়া যাচ্ছে ফুটপাতে। দেড়শ’ থেকে চারশ’ টাকায় শার্ট বিক্রি হচ্ছে এসব দোকানে।
স্ত্রীকে নিয়ে সাড়ে সাতশ টাকায় তিন জোড়া স্যান্ডেল কেনা কামরাঙ্গিরচরের সাইদুল ইসলাম রবিন বলেন, “বউ-বাচ্চার জন্য কিনলাম। বাচ্চাদের জন্য জামাও কিনেছি। তাদের ঈদ উপলক্ষে কিছু দিতে পারছি, এইটাই অনেক।”