এই অবসরে তিনি জীবন থেকে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানালেন তার ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
শনিবার দুপুরের পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর সময় ভাইয়ের শেষ সময়ের স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
মোমেন বলেন, “শেষ কয়েকদিন যাবৎ তিনি বারবার বলছিলেন, তিনি চলে যেতে চান। বলতেন- ‘আমার কাজ শেষ, এবার আমি চলে যেতে চাই, বাকিটা তোমরা দেখো’।
“গত এক সপ্তাহ চলে যাওয়ার জন্য স্থির হয়েছিলেন তিনি। অবশেষে তিনি চলেই গেলেন।”
৮৮ বছর বয়সী মুহিত শুক্রবার রাতে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গত বছর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
শনিবার সকালে গুলশানের আজাদ মসজিদে জানাজার পর পৌনে ১টায় মুহিতের কফিন নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়।
রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাউদ্দিন ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কবির আহমেদ কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিনের পক্ষে সংসদের সার্জেন্ট অ্যান্ড আর্মস কমডোর এম নাইম রহমান শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাউদ্দিন ইসলাম শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের উপদেষ্টা পরিষদের প্রয়াত এই সদস্যের প্রতি।
শিক্ষা ও কর্মজীবনে মুহিতের কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরে ওবায়দুল কাদের বলেন, “আমি এরকম কাজ পাগল মানুষ কমই দেখেছি। কাজে আর পড়াশোনায় ডুবে থাকতেন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ছুটির দিনেও দেখা যেত, সচিবালয় বন্ধ আবুল মাল আবদুল মুহিতের অফিসে আলো জ্বলছে। তিনি এ রকম মানুষ ছিলেন।”
কাদের বলেন, “তিনি অর্থনীতিবিদ হিসেবেও সফল, অর্থমন্ত্রী হিসেবেও সফল। সবচেয়ে বড় কথা হল এ দেশের রাজনীতিতে সৎ মানুষ খুব বেশি নেই। তিনি শতভাগ সৎ লোক ছিলেন।”
মুহিতের সঙ্গে মন্ত্রিসভায় থাকা আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, “আবুল মাল আবদুল মুহিত শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বে একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন। তার মধ্যে দায়িত্ববোধ ও মানবিক গুণাবলি ছিল, উনার মতো সফল আমাদের কয়জনের আছে।”
মোমেন বলেন, “তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন, আমরা যেন তেমন একটি সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ গড়তে পারি, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে পারি।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শনিবার সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রতি সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় ভাইয়ের শেষ দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
আবুল মাল আবদুল মুহিত: সাহিত্যের ছাত্র থেকে অর্থনীতির জটিল জগতে
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) যোগ দেওয়া মুহিত পরের সিকি শতাব্দী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকরিতে থাকাকালেই ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করেন, ১৯৬৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি পান।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন মুহিত। স্বাধীনতার পর সচিব হিসেবে ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছা অবসরে যান মুহিত। এরপর ‘অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে’ কাজ শুরু করেন ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও আইএফএডি-তে। মাঝে এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে পালন করেন এক বছর।
এই শতকের শুরুতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সরাসরি রাজনীতিতে নামেন। ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর হন অর্থমন্ত্রী। টানা ১০ বছর সেই দায়িত্ব পালনের পর ২০১৮ সালে নিজেই যান অবসরে যান।
শ্রদ্ধা জানিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “যারা স্বাধীনতা এনেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম আবুল মাল আবদুল মুহিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটনে ছিলেন এবং প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ভুমিকা রেখেছে, প্রবাসীদের প্রচেষ্টা না থাকলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি আন্দোলনে সম্ভব ছিল না।”
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “তিনি দেশের অর্থনীতিতে নানাভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। উনি যে কাজের মধ্যে ছিলেন, এটা আমরা ধরে রাখতে পারলে দেশের কল্যাণ হবেই।”
সাবেক মন্ত্রী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “তিনি আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিকে চমৎকারভাবে সন্নিবেশ করেছিলেন। তিনি যা ভাবতেন তা বাস্তবায়নও করতে পারেন, এটা দেখিয়েছেন।”
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “অত্যান্ত সরল, সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ ছিলেন মুহিত সাহেব। আমলাতন্ত্র বলি, রাজনৈতিক ব্যক্তি বলি, আর মন্ত্রী বলি, তিনি বিরল ব্যক্তিত্ব।”
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বহু গুণে গুণান্বিত মুহিত ভাই। আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ থেকে একজন মেধাবী লোককে হারালাম, সাংস্কৃতিক জগতের একজন পৃষ্ঠপোষককে হারালাম, অর্থনৈতিক জগতের একজন বাস্তবভিত্তিক অর্থনীতিবিদ হারালাম।”
তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “বাংলাদেশ যে আজকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশ যে আজকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, এক্ষেত্রে তিনি (মুহিত) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বোতভাবে সহায়তা করেছেন।
“ভব্যতা-ভদ্রতাসহ অনেক কিছু তার কাছে শেখার ছিল। কনিষ্ঠ ও অনুজদের মুহিত ভাই যেভাবে আপন করে নিতেন, তা ছিলো অভাবনীয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, পুজা উদযাপন পরিষদ, জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন, অর্থ মন্ত্রণালয়, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ভারতীয় হাইকমিশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সার্বজনীন পুজা উদযাপন কমিটি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে কফিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সিলেটে রোববার জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে মুহিতকে।