ঈদ বাজারে ব্যস্ত জুতার দোকানে এ কারণে নাগরা নিয়েও আগ্রহ দেখা গেল অনেকের। ক্রেতা চাহিদা থাকায় বিক্রেতারাও বিশেষ ধরনের এ জুতায় এনেছেন বৈচিত্র, দেশি-বিদেশি নকশায় সাজিয়েছেন সম্ভার।
কোভিড মহামারীতে স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়িতে আগের দুই বছর যে ভাটা ছিল, এবার ঈদের দীর্ঘ ছুটি যেন ক্রেতা দর্শনার্থীদের বাড়তি ঘোরার সুযোগ করে দিয়েছে। এর রেশ দেখা গেছে জুতার জন্য বিখ্যাত নগরীর বাটা সিগন্যাল এলাকার এলিফ্যান্ট রোড, চৌরঙ্গী ভবন, জাহানারা ভবন, গফুর ম্যানশন কিংবা নিউ মার্কেটসহ আশপাশের বেশ কিছু মার্কেটের জুতার দোকানগুলোতে।
আনুষ্ঠানিক ছুটি শুরুর পর শুক্রবার থেকে বেশ ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এক শোরুম থেকে আরেকটিতে ঘুরে পছন্দের জুতা খুঁজছেন অনেকেই। পরিবার নিয়ে যেমন ছিলেন অনেকে, তেমনি দল বেঁধেও ঢু মারতে দেখা গেছে।
এসব দোকানে নানা নকশার ‘নাগরা’র প্রতিও বিশেষ আকর্ষণ দেখা গেল অনেকের। এদের মধ্যে তরুণ ও তরুণীর সংখ্যাই ছিল বেশি।
দোকানিরা জানালেন, বিশেষ করে শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে ছোট-বড় অনেকেই যে কোনো উৎসব উপলক্ষে এখন নাগরা পরে থাকে। বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনের নাগরা এবং সচরাচর ব্যবহারের নাগরার মধ্যেও রয়েছে পার্থক্য।
শুক্রবার নিউমার্কেটের এক দোকানি বললেন, “এমন অনেক কাস্টমার আছেন, যারা নাগরা খোঁজেন, তাদের জন্য কিছু ভালোমানের নাগরা আমাদের সংগ্রহে রয়েছে। অনেকেই ঈদের ড্রেসের সাথে মিল রেখে নাগরা নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ জামা হাতে নিয়ে এসে ম্যাচিং করে কেনে।”
নিউ মার্কেটে কথা হয় নাগরা কিনতে আসা আফসানার সঙ্গে। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে জামার সঙ্গে ম্যাচিং করে নকশা করা নানা ডিজাইন দেখছেন। তিনি বলেন, “এখনকার নাগরায় বেশ কারুকাজ থাকে, সাধারণত ফ্লাট হয়। এ জন্যই ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে এই ঈদে এ জুতো নিলাম। এখন যে কোনো অনুষ্ঠানে এমন নাগরা পরার চল আছে।”
ব্যবসায়ীরা জানান, ক্রেতাদের পছন্দের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশি ডিজাইনাররা নাগরাতে এনেছেন নানা বৈচিত্র ও পরিবর্তন। জরি, চুমকি, রাজস্থানি কারুকাজ ছাড়াও নাগরায় হাতে তৈরি বাহারি নকশিকাঁথার কাজও করা হয়ে থাকে। এসব কারুকাজে ভরপুর নাগরাই এখন বেশি পছন্দ ক্রেতাদের।
নকশায় বদল আসায় এক সময়ের জনপ্রিয় সামনের অংশে বাঁকানো নাগরার ব্যবহার অনেকটা কমে এসেছে বলে জানালেন দোকানিরা।
দেশি নাগরা ছাড়াও ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা ভারত ও পাকিস্তান থেকে নাগরা ‘বিশেষ অর্ডার’ দিয়ে বানিয়ে আনছেন।
যেভাবে এল নাগরা
মোগল আমলের আগে ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু জায়গায় চীনাদের প্রভাব ছিল। চীনা ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলে এক ধরনের নাগরার প্রচলন করলেও তা তৎকালীন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী ছিল না। কাঠ দিয়ে তৈরি তাদের নাগরা ব্যবহার করা ছিল কষ্টকর।
পরে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে স্থানীয় চর্মকাররা নাগরার আদলে বেশ কিছু জুতা তৈরি করতে থাকে। এরপর থেকে মোগলদের মধ্যে নাগরা ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়।
ইতিহাস বলছে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে মোগল দরবারে সবার পায়ে রত্নখচিত নাগরার শোভা পেত। ওই সময় নাগরার ওপর সোনা ও রুপার সুতা দিয়ে নকশা করে তাতে মণিমুক্তা বসিয়ে নাগরাকে ‘শাহী জুতায়’ পরিণত করা হয়।
তখন থেকে নাগরাকে কোথাও জুত্তি, খুসসা, মাজোরি নামেও ডাকা হয়। পরে এ অঞ্চলে নাগরা নামে ডাকা শুরু হয়।
দামে কেমন?
কয়েকজন ক্রেতা জানান, চৌরঙ্গী ভবন, গফুর ম্যানশনসহ বেশ কিছু দোকানে ‘আসল’ পাকিস্তানি নাগরা পাওয়া যায়। তবে এবার দাম অন্যান্য বারের চেয়ে কিছুটা বেশি বলে তাদের মনে হয়েছে। কিছু দোকানে স্থানীয়ভাবে তৈরি নাগরাও পাওয়া যায়। তবে সেগুলোতে কাজ কম, মানেও কিছুটা হেরফের রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে দেশের বাজারে প্রধানত পাকিস্তানি ও ইন্ডিয়ান, এ দুই ধরনের নাগরার জনপ্রিয়তা বেশি। নকশা ও কারুকাজ এবং মানভেদে এর দামেও রয়েছে তফাৎ। পাকিস্তানি নাগরা টেকসই ও কাজ বেশি বলে দামও একটু বেশি।
বাটা সিগন্যাল এলাকার চৌরঙ্গী ভবনের মা মনি সুজের স্বত্বাধিকারী মিনহাম দেওয়ান জানান, তাদের সংগ্রহে থাকা ভারতীয় নাগরার দাম ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা এবং পাকিস্তানি এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা।
“ফ্যাশনপ্রিয় মানুষেরাই বেশি নাগরা ব্যবহার করে থাকে, সারাবছর বিক্রি থাকলেও ঈদে বিক্রি বেড়ে যায়।“
তিনি বলেন, “বিয়ে ছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে এখন নাগরার চল শুরু হয়েছে। অনেকেই ঈদের পাঞ্জাবি-পায়জামার সঙ্গে ম্যাচিং করে নাগরা পরতে পছন্দ করে। নারীরাও ড্রেসের সাথে মিল রেখে নাগরা পরে। এজন্য বিপণী বিতানে ড্রেস কিনেই নাগরার কালেকশন দেখতে চলে আসেন এখানে।”
নিউ এলিফ্যান্ট রোডের আপন সুজের মালিক মো. সোহেল হোসাইন বলেন, “১ হাজার ২৯০ থেকে ১ হাজার ৯৯০ টাকার মধ্যে পাকিস্তানি নাগরার নানা কালেকশন রয়েছে। আর ইন্ডিয়ান একটি কালেকশনই আছে ১ হাজার ৯০ টাকা দাম।”
পাকিস্তানি নাগরা বেশি চলে জানিয়ে তিনি বলেন, “ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী আমরা ডিজাইন করে দেই। সেইভাবে ওই দেশ থেকে আমাদের এখানে নাগরা আসে।”
পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে খুঁজছেন তারা
নিউ মার্কেটের পপুলার এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্বাস আলী জানান, তাদের দোকানে নানা সংগ্রহের মধ্যে নারীদের জন্য নাগরাও রয়েছে।
“এমন অনেক কাস্টমার আছেন, যারা নাগরা খুঁজেন, তাদের জন্য কিছু ভালোমানের নাগরা আমাদের সংগ্রহে রয়েছে। অনেকেই ঈদ ড্রেসের সাথে মিল রেখে নাগরা নিয়ে থাকেন। কেউ কেউ জামা হাতে নিয়ে এসে ম্যাচিং করে কিনেন।”
বিয়ের অনুষ্ঠানে বর কনে সাধারণত যেসব নাগরা পরে থাকেন এর সঙ্গে অন্য সময়ের নাগরার বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।
এলিফ্যান্ট রোডের বিয়ের সরঞ্জামের দোকান ‘মহাবীর’ এর মালিক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “বিয়ের অনুষ্ঠানে বরের শেরওয়ানী-পাগরী এবং কনের শাড়ির সাথে মিল রেখে নাগরা নিয়ে থাকে। এই নাগরা সাধারণ ওয়ান টাইম ব্যবহারের জন্য। কিন্তু অন্যান্য অনুষ্ঠানে যারা নাগরা পরেন সেগুলোর মান বেশ ভালো থাকে।”
সারা বছরই নাগরার চাহিদা থাকায় ব্যবসাও ভালো বলে জানান আজাদসহ অন্য ব্যবসায়ীরা।