চা শ্রমিকরা বলেছেন, প্রতিবছর মে দিবস এলেই নিজেদের অধিকার আদায়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন নেতারা। কিন্তু তাতে শ্রমিকদের ভাগ্য ফেরে না। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাতা তোলেন চা শ্রমিক নারীরা। যাদের হাতের পরশে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়; তাদেরই বেতন বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ৫০ বছরের হলেও চা শ্রমিকদের শ্রম-ঘামের ইতিহাস প্রায় পৌনে ২০০ বছরের। এ বছর মে দিবসে ভূমি অধিকার প্রদান এবং জীবন চলার উপযোগী করে বেতন বৃদ্ধি চা শ্রমিকদের প্রধান দাবি।
বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলায় ৯৩টি চা বাগানে প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা জানান।
চা শ্রমিক নেতা পরিমল সিং বারাইক বলেন, “মজুরি ১২০ টাকা আর কিছু রেশন। এই দিয়েই মা বাবা, স্বামী সন্তান নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন চা শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের গল্প এখনকার এই আধুনিক যুগেও কল্পকথার মতোই মনে হবে, যদি না কাছে এসে তাদের কেউ না দেখে।”
চা শ্রমিক নেতা শ্রীমঙ্গল রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জী বলেন, “বর্তমানে চা বাগানে বেড়েছে জনসংখ্যা। প্রতি ঘরে অন্তত দুই-তিন জন করে কাজ করার সক্ষমতা থাকলেও বাগানে কাজ মাত্র একজন করে। কোনো কোনো পরিবারের কাজ আবার অস্থায়ী। তাদের দৈনিক বেতন মাত্র ৮৫ টাকা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্যানিটেশনও অপ্রতুল।”
চা শ্রমিক নেতা শিক্ষক দিলীপ কৈরী জানান, এক জমিতে পৌনে ২০০ বছর বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছেন তারা। আর কতবছর থাকলে এই জমির মালিক হতে পারবে চা শ্রমিকরা? বসতি অনুযায়ী চা বাগানের বাইরে অনান্যরা জমির মালিক হয়েছেন। এদিকে যারা শ্রমে-ঘামে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন তাদের ভাগ্যে জোটে না ভূমি অধিকার।
শ্রমিকদের শিক্ষার মান বাড়াতে দেশের সকল চা বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা জরুরি বলে মনে করেন চা শ্রমিক নেতা মো. সেলিম হক।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সব চা বাগানের বিদ্যালয় স্থাপন হয়নি। শুধুমাত্র শ্রীমঙ্গলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কয়েকবছর আগে একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।”
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বালিশিরা ভ্যালির সভাপতি বিজয় হাজরা জানান, ১৮৫৪ সাল থেকে প্রথম বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয় সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানে। তারও আগে ব্রিটিশ ও চা বাগানের মালিকরা ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই এলাকায় লোকজনদের নিয়ে আসে। জঙ্গল পরিষ্কার করে চা আবাদ করেন সেইসব মানুষেরা। এর বিনিময়ে তাদের দেওয়া হতো বিশেষ এক ধরনের কাঁচা টাকা। যা বাগানের বাইরে চলত না।
চা বাগান করতে গিয়ে বহু মানুষ সাপের দংশনে ও বন্যপ্রাণীর আক্রমণে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। টাকা না থাকায় তাদের আর নিজ দেশে ফেরা হয়নি। বাধ্য হয়ে যুগের পর যুগ তারা চা উৎপাদনের সঙ্গেই মিশে থাকেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাখন লাল কর্মকার বলেন, এখন চা শ্রমিকদের মূল দাবি তাদের ভূমি অধিকার।
শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেটের চেয়ারম্যান জি এম শিবলী বলেন, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বাগান মালিকরাও কাজ করছেন। বর্তমান বেতন ১২০ টাকা হলেও এর সঙ্গে ঘর, চিকিৎসা, রেশন, জ্বালানি সংযুক্ত করলে তাদের বেতন পড়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ টাকা।
প্রতি দুই বছর পর পর চা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে মালিক পক্ষের দ্বিবার্ষিক চুক্তি হয়। এ সময় বাধ্যতামূলক বেতন বাড়ানো হয়। আগামী চুক্তিতেও বেতন বাড়বে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. এ কে এম রফিকুল হক বলেন, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুদানের পরিপ্রেক্ষিতে চা বাগানের শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষার মান উন্নয়নে বাংলাদেশ চা বাগান শ্রমিক শিক্ষা ট্রাস্ট গঠিত হয়। ট্রাস্ট গঠনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ হাজারের অধিক শ্রমিক সন্তানদের বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।
প্রাধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে অনান্য সুবিধাও অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি।