এই শ্রমিকদের শ্রমে উত্তোলন করা কয়লা দিয়ে ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিটে উৎপাদন হচ্ছে; যা সরাসরি যোগ হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে এক হাজার ১৪৭ জন বাংলাদেশি শ্রমিকের বিপরীতে কাজ করেন ২০০ চীনা শ্রমিক। খনিটি রাষ্ট্রীয় সম্পদ হলেও, কয়লা উত্তোলন কাজে চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি/সিএমসি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে সরকার চুক্তিবদ্ধ।
বাংলাদেশি শ্রমিক এরশাদ হোসেন জানান, তারা ভূ-গর্ভের এক হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার ফিট গভীরে কাজ করেন। সেখানে তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গেট পাশ জমা দিয়ে খনিতে নামার সময় কোনো নিবন্ধন খাতায় নাম লেখা হয় না- এমন অভিযোগ করে এরশাদ বলেন, “খাতা ব্যবহার না করায় ভিতরে কেউ নিখোঁজ হলে কোনো প্রমাণ থাকবে না। অথচ কর্মকর্তারা ভূ-গর্ভে নামলে তাদের ক্ষেত্রে খাতা রক্ষা করা হয়।”
একবার নামার পর কাজ শেষ না করে খনি থেকে ওঠার নিয়ম নেই জানিয়ে শ্রমিক সোহাগ বলেন, “কাজের আট ঘণ্টা প্রচণ্ড তাপের মধ্যে সেখানেই থাকতে হয়। সেখানে খাবার খাওয়ার কোনো পরিবেশ নেই। পানি আর বিস্কুট বা শুকনা খাবার খেয়েই থাকতে হয়।”
“কারণ, কয়লার কালো কালি আর শরীরের ঘাম একাকার হয়ে যায়। ভূ-গর্ভ থেকে বের হওয়ার পর নিজেকে নিজেই চিনতে পারি না।”
আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলেও ওভারটাইম না পাওয়ার অভিযোগ এসেছে শ্রমিক হযরত আলীর কাছ থেকে।
বড়পুকুরিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেতন সর্বনিম্ন ২২ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। নেই বিমা ব্যবস্থা। দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক পঙ্গু হলে পান ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
চীনা শ্রমিকরা খনিতে ডলারে বেতন পেলেও সেই অংকটি জানা যায়নি।
খনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে পাঁচটি কয়লা খনি থাকলেও একমাত্র বড়পুকুরিয়া খনির মধ্য ও দক্ষিণ অংশ থেকেই কয়লা উত্তোলন করা হয়। ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে ২০০৫ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এখানে কয়লা তোলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ১৯৮৫ সালে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির সন্ধান পায়। এই খনিতে ভূপৃষ্ঠের ১১৮ মিটার থেকে ৫০৬ মিটার গভীরতায় পাঁচ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে কয়লা রয়েছে। এখানে কয়লা ব্যবহারের জন্য একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। যদিও এখানকার উৎপাদিত সব কয়লা সেখানে ব্যবহার হয় না।
খনির প্রকৌশলীরা জানান, এখানকার কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উৎকৃষ্ট মানের। এই কয়লায় সালফার কম।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির একজন শ্রমিক বলেন, অন্য পেশার চেয়ে এটি ভিন্ন। অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েই শ্রমিকরা এখানে কাজ করেন। তারা প্রতিদিন সকালবেলায় কাজে বের হন। কাজে যাওয়ার সময় তাদের রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন মাপা হয়। টর্চলাইট লাগানো বিশেষ হেলমেট থাকে সবার।
সব ঠিক থাকলে পরে লিফটে উঠে শ্রমিকরা চলে যান মূল খনিতে; মাটির প্রায় এক হাজার ফুট গভীরে। সেখান থেকে কয়েক মাইল হেঁটে খনি এলাকার দিকে অগ্রসর হতে হয়। খনির অভ্যন্তর অন্ধকার। সেখানে বায়ুপ্রবাহ ব্যাহত হয়। আদ্রতা প্রচুর। সাধারণ চাশমা মুহূর্তেই ঘোলাটে হয়ে যায়। মাটির যত গভীরে যাওয়া যায় ততই তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। সেখানে বিশেষ ‘মাইন কার’ও থাকে।
খনি চালু হওয়ার পর এখানে খুব বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় হয়নি। তবে ছোট ছোট দুর্ঘটনা ঘটে না এমন নয়। শ্রমিকদের মৃত্যু হয়।
কাজের পরিবেশ ও বেতন-ভাতা নিয়েও শ্রমিকদের অসন্তোষ আছে। বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকরা মাঝে মাঝে সেখানে আন্দোলনও করেন। এখন আন্দোলন চলছে, মহামারীর সময় বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাওয়া শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে আনার দাবিতে।
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রবিউল ইসলাম বলেন, কোভিড মহামারীর সময়ে বাংলাদেশি এক হাজার ১৪৭ জন শ্রমিককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর পর তাদের মধ্যে থেকে মাত্র ৪০০ জনকে কাজে ফিরিয়ে আনা হয় চলতি জানুয়ারিতে।
কাজের বাইরে থাকা বাকি শ্রমিকদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা না হলেও বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে না তাদের।
খনির শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান জানান, তারা চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে এক ধরনের ‘নির্যাতনের’ শিকার হচ্ছেন।
“এখানে কোনো শ্রম অধিকার নেই। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও কর্মরত ৪০০ বাংলাদেশি শ্রমিক ‘বন্দিজীবন’ পার করছেন। তাদের খনির বাইরে যাওয়ার অধিকার নেই। নেই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার অধিকার।”
শ্রমিকদের এসব অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করেছেন বড়পুকুরিয়ার কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান।
“তাদের বেতন প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ হারে বাড়ে এবং বিধি মেনেই ভূ-গর্ভে নামানো হয়।”
বিমা প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা জানান, চুক্তিনামায় শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ উল্লেখ আছে এবং চুক্তি অনুযায়ী সেটি তারা পেয়েও থাকেন। তবে টাকার পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ হাজারের বেশি হয় বলে জানান তিনি।