কোভিড মহামারীর
কারণে দুই বছরের চারটি ঈদ কেটেছিল বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে। এবার সংক্রমণ একদম কমে আসায়
অনেকটা মুক্ত পরিবেশে ঈদ করবে মানুষ, সঙ্গে দীর্ঘ ছুটিও মিলেছে। এ কারণে তিক্ত অভিজ্ঞতা
থেকে অনেকেরই আশঙ্কা ছিল সড়ক ও মহাসড়কে উপচে পড়া ভিড় থাকবে; যানজটে আগের চেয়ে জেরবার
হতে হবে। তবে এবার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।
এনা ট্রান্সপোর্টের
এসি বাসের চালক আব্দুর রশীদ কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থেকে ফিরে এসে দুপুর ১২টার দিকে
দাঁড়িয়ে ছিলেন মাজার রোডের একটি পাম্পের সামনে।
তিনি বললেন,
“এবার পরিস্থিতি নরমালের চাইতেও ভালো। যাওয়ার সময় তেমন যানজট পালাম না। ফেরার সময় যমুনা
সেতুর টোল প্লাজার আগ দিয়া যানজট পালাম। তাও গাড়ি উল্টাপাল্টা না ঢুকালি পরে সেটুকুও
হত না।”
আনুষ্ঠানিক
ছুটি শুরুর দিন শুক্রবারের মত শনিবারও বিকাল পর্যন্ত গাবতলীতে ঈদের সেই পরিচিত ভোগান্তির
দৃশ্য চোখে পড়েনি। দেখা যায়নি কোনও বিশৃঙ্খলাও।
উল্টো যাত্রী
পেতে পাটুরিয়া ঘাটমুখী বাসগুলোর কর্মীরা হাঁকডাক করছেন, যাত্রী ধরে টানাটানিও করছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদযাত্রায় এ যেন এক বিরল দৃশ্য।
রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে ১টার বাস সোয়া ১টায় কাউন্টার ছেড়ে যাচ্ছে।
অপরদিকে
তৎপর দেখা গেল সেখানকার পুলিশ সদস্যদেরও। বিভিন্ন নির্দেশনা লেখা লিফলেট হাতে কিছু
দূর পরপর দাঁড়িয়ে পুলিশ সদস্যরা। কোনো বাস যাত্রী তুলতে একটু বেশি সময় রাস্তায় দাঁড়ালেই
বাঁশি ফুঁকে ছুটে যাচ্ছেন তারা।
পুলিশ সদস্য
রবিউল ইসলাম বলছেন, “ঈদের গাবতলী এত ফাঁকা এর আগে দেখি নাই। গাবতলীতে ভিড় হবে, হই-হল্লা
হবে দেখে আমাদের শখানের লোকজনকে এখানে রাখা হয়েছে। ভিড়-ভাট্টা নেই দেখে সবাই অনেক রিলাক্সে
আছে।”
২০ ঘণ্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে সাড়ে ৭ হাজার মোটরসাইকেল পার
ঈদযাত্রা: চাপ বেড়েছে কমলাপুরে, তিন ট্রেনে বিলম্ব
ঈদের সময় প্রতিদিন ঢাকা ছাড়বে ৩০ লাখ মানুষ: জরিপ
তিনি জানান,
পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে তিনিসহ অনেক পুলিশ সদস্য ছুটির দরখাস্ত দিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতনদের
কাছে। তার দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে বলে কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। বাড়ি
যাওয়ার আনন্দ যেন চোখে-মুখে খেলছে রবিউলের।
কারখানা ছুটির পর ছন্দপতন
শুক্রবারের
পর শনিবার বিকাল পর্যন্ত সবাইকে অবাক করে সড়কে নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রায় কিছুটা চাঞ্চল্য
তৈরি হল বিকালের পর শিল্পাঞ্চলগুলোতে কারখানা ছুটি হওয়া শুরু হলে।
রাজধানী
ঢাকার আশেপাশের শিল্প কারখানায় বিশেষ করে পোশাক কারখানা ছুটির পর মানুষের ঢল নামে সাভার
ও গাজীপুরে। হঠাৎ বিপুল সংখ্যক কর্মী গ্রামমুখী হতে চাইলে গাড়ির অভাবে আর যানজটে দুর্ভোগে
পড়তে হয় তাদের।
শনিবার
দুপুরের পর গাজীপুরে ঢাকা-ময়মমনসিংহ মহাসড়ক এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ঘরমুখো মানুষের
চাপ বাড়তে থাকে। দুপুর ২টা পর্যন্ত মহাসড়কে থেমে থেমে জট থাকলেও সন্ধ্যার পর তা দীর্ঘ
হতে শুরু করে কারখানা থেকে কর্মীদের ঢল নামলে।
একই চিত্র
দেখা গেছে ঢাকার সাভারে ও আশুলিয়ায়। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে নবীনগর পর্যন্ত, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে নবীনগর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত প্রায় ১৫
কিলোমিটার যানজটে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে ঘরমুখো মানুষদের।
কুমিল্লায় যানজট নেই, চট্টগ্রাম মহাসড়কেও স্বস্তি
শিমুলিয়া-পাটুরিয়া ঠাসা ঘরমুখোদের ভিড়ে
ঈদযাত্রা শুরু: ট্রেনে দেরি, বাসে ভিড় কম হলেও বেশি লঞ্চে
বাস না
পেয়ে যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়ায় মিনিবাসে, মাইক্রোবাসে, ট্রাকে, মোটরসাইকেলে, পিকআপে
করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রওনা হয়েছেন গন্তব্যের উদ্দেশে।
দিনভর যানজট নেই উত্তরের পথে
বেসরকারি
সংস্থার কর্মকর্তা মুনিয়া ইসলাম ঈদ করতে শ্বশুরবাড়ি ঠাকুরগাঁও পৌঁছেছেন পৌনে ৯ ঘণ্টায়।
তিনি বলেন,
“স্বাভাবিক সময়েও তো ১০ ঘণ্টা লাগে। এবার একেবারে রেকর্ড তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেছি। গত ১০
বছরে কখনও এত স্মুথলি আসতে পারিনি।”
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে শনিবার দিনের যান চলাচল
শনিবার
ভোর ৫টার দিকে ঢাকা থেকে নিজেদের গাড়িতে করে দুই সন্তান ও স্বামীসহ রওনা দেন মুনিয়া।
বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ঠাকুরগাঁওয়ে পৌঁছে গেছেন।
তিনি জানান,
বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজার আগে ঘণ্টা দেড়েকের যানজট ছিল। এরপর রাস্তায় আর কোথাও থেমে
থাকতে হয়নি। অনেক গাড়ির চাপ, তবে সবাই চলতে পেরেছে।
শুক্রবার
রাতে বোনসহ এনা পরিবহনের গাড়িতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র আদিব হোসেন। বেলা ১১টার দিকে পৌঁছে গেছেন। মোটামুটি ১২ ঘণ্টা সময় লেগেছে।
স্বস্তির ঈদযাত্রায় দুই চাকার জোয়ার
কারখানা ছুটির পর সাভার-গাজীপুরে যাত্রীর ঢল, সড়কে দুর্ভোগ
পদ্মার শরীয়তপুর-চাঁদপুর ফেরিঘাটে ৭০০ গাড়ির জট
আদিব বলেন,
“ভেবেছিলাম বাসে গেলে জ্যাম হবে। তাই ট্রেনের টিকিট খুঁজছিলাম। ট্রেনের টিকিট না পেয়ে
অগত্যা বাসে উঠেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ট্রেনের থেকে অনেক ভালো এসেছি।“
আল হামরা
পরিবহনের কর্মী অলক কুমার বলেন, “এবারের রোড ম্যানেজমেন্ট খুবই ভালো। রাস্তায় প্রচুর
পুলিশ। এর আগে কখনও এরকম দেখিনি। যেটুকু জ্যাম হচ্ছে তাও ড্রাইভারদের পাড়াপাড়ির কারণে।
“আর রাস্তায়
এখন অনেক বেশি ছোট গাড়ি আর মোটরসাইকেল। বিশেষ করে বড় গাড়ির আশপাশ দিয়ে মোটরসাইকেলগুলো
যেভাবে সাই সুই করে চলে যাচ্ছে তাতে যে কোনো সময় বিপদ ঘটতে পারে। আর এত গুড়াগাড়া গাড়ির
কারণে সেতুতে সময় লাগছে অনেক বেশি।”
কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনিবার দিনের চিত্র
দুপুর ১টার
গাইবান্ধাগামী বাস সোয়া ১টায় ছেড়ে যাচ্ছে জানিয়ে অলক বলেন, “রাস্তার খবর নিলাম। একেবারে
এলেঙ্গা পর্যন্ত কোনো যানজট নেই। এরপর সেতুর টোলে থেমে থাকতে হচ্ছে কিছুক্ষণ। টোল দিয়ে
বের হয়ে একেবারে বগুড়ার ফুড ভিলেজ পর্যন্ত রাস্তা ভালোই আছে। তবে ফুড ভিলেজ থেকে বগুড়া
হয়ে গোবিন্দগঞ্জ পর্যন্ত জ্যাম লাগছে দুপুর বেলায়।”
শুধু উত্তরের
পথে নয়, ঢাকা থেকে দেশের অন্যান্য মহাসড়কে সকালের দিকে গাড়ির একটু চাপ থাকলেও দুপুরের
পর সব জায়গা থেকে যানজটের খবর আসেনি। ট্রেন বা লঞ্চ চলাচলও ছিল অনেকটা স্বাভাবিক। সংবাদ
মাধ্যমে সেই পুরনো ঘণ্টাব্যাপী লাইনে দাঁড়ানো গাড়ির সারির ছবিও ছাপা হয়নি।