বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজের খোঁজে আসা মানুষের
কোলাহলে মুখরিত খুলনা কালের পরিসরে বদলে গেছে অনেকটাই। আর নিদারুণ অসহায় হয়ে পড়েছেন
পাটকল-নির্ভর শ্রমিকরা, যে পাট একসময় ছিল দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির
সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, “১৯৯৩ সালে খুলনা টেক্সটাইল মিলটি বন্ধ করে দেওয়া
হয়, যা ছিল ২৬ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি বড় কারখানা। ভারি শিল্প বন্ধের সেটিই ছিল
প্রথম।
“এরপর প্রতিনিয়ত এই শিল্প শহরের চেয়ারা
বদলে যায়।”
আশরাফ বলেন, “সরকারি হার্ডবোর্ড মিল, নিউজ
প্রিন্ট মিল ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সবশেষে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ
ঘোষণা করা হয়। এই পাটকলের মধ্যে রয়েছে খুলনা অঞ্চলেরই নয়টি।”
বেসরকারি উদ্যোগে খুলনায় নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান
গড়ে উঠলেও তা পাটকল-শ্রমিকদের ভাগ্য বদলাতে পারেনি। বরং কাজ হারানো এই শ্রমিকদের দীর্ঘশ্বাসে
ভারি হয়ে থাকে খুলনার খালিশপুরের মত জমজমাট শিল্প এলাকা।
২০২০ সালের ২ জুলাই খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত
পাটকলগুলোর গেটে বন্ধের নোটিশ ঝোলানো হয়। তার পরদিন সকাল থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়
সেগুলো। সেদিনই পাটকল শ্রমিকদের কষ্টের দিন শুরু হয় পাকাপাকিভাবে।
প্লাটিনাম জুটমিলের সর্বশেষ সিবিএ সভাপতি
শাহানা শারমিন বলেন, “পাটকলগুলো বন্ধের প্রায় দুই বছরেও চালুর ব্যাপারে কার্যকর কোনো
পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
“শ্রমিকরা জানতেন বেসরকারি উদ্যোগে পাটকলগুলো
আবার চালু হবে। আগে কাজ করা শ্রমিকরা সেখানে প্রাধান্য পাবেন। সেই আশাতেই শ্রমিকরা
পাটকলগুলোর আবাসিক এলাকা ছেড়ে খালিশপুরের আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। কিন্তু
এখন তারা হতাশ। এসব পাটকল আদৌ চালু হবে কিনা তা নিয়ে তারা এখন সন্দিহান।”
শাহানা বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব
২০২০ সালের ২ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো
বন্ধের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেছিলেন, শ্রমিকদের শতভাগ পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু
গত দুই বছরেও শ্রমিকরা তাদের পাওনা বুঝে পাননি। স্থায়ী শ্রমিকরা পাওনার কিছু অংশ পেলেও
অস্থায়ী শ্রমিকরা কোনো টাকাই পাননি; কবে পাবেন তাও পরিষ্কার না।”
পাটকল বন্ধের পর শ্রমিকদের অর্ধেক টাকা
নগদ এবং অর্ধেক টাকা সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করে বিজেএমসি। কিন্তু
এখনও বেশির ভাগ শ্রমিক পাননি; কবে পাবেন তারও ঠিক নেই।
বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) খুলনা
অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা বলেন, খুলনা অঞ্চলের নয়টি পাটকলে স্থায়ী শ্রমিক ছিলেন ১৪ হাজার
৯৮৭ জন। তাদের মধ্যে এক হাজার ৫৪ জন তাদের পাওনা নগদ ৪৩ কোটি টাকা এবং নয় হাজার ৪৮১
জন শ্রমিক তাদের পাওনা ৪৯২ কোটি ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এখনও পাননি।
“এছাড়া খুলনার সাতটি পাটকলের ২১ হাজার ৩৫১
জন অস্থায়ী শ্রমিকের পাওনা ১৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তারাও কেউ এখনও কোনো টাকা পাননি। পাশাপাশি
রাষ্ট্রায়ত্ত খালিশপুর জুটমিলের চার হাজার ৪৭৪ জন ও দৌলতপুর জুটমিলের ৩৫০ জন শ্রমিক
দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতেন। কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে তারাও কোনো টাকা পাননি।”
বিজেএমসির মহাব্যবস্থাপক ও খুলনা অঞ্চলের
সমন্বয়কারী গোলাম রাব্বানী বলেন, অস্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের বিষয়ে তাদের কাছে
এখনও কোনো নির্দেশনা পাঠায়নি সরকার।
বন্ধ কারখানা চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, বন্ধ
পাটকল ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দুইবার দরপত্র আহ্বান করে মাত্র একটি কারখানা
ইজারা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
কারখানা চালুর নিশ্চয়তা না থাকায় ইতোমধ্যে
খালিশপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন অনেক শ্রমিক। যারা আছেন তারা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন
কাটাচ্ছেন। দীর্ঘদিন আয়-রোজগারহীন এসব মানুষের স্বাস্থ্য চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঈদের আগে শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধের পাশাপাশি
পাটকলগুলো সরকারি ব্যবস্থাপনায় পুনরায় চালুর দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা।
এদিকে পাটকলগুলো অলস পড়ে থাকতে থাকতে এর
যন্ত্রপাতিতে জং ধরে যাচ্ছে।
সরেজমিনে খালিশপুর শিল্পাঞ্চলে গিয়ে দেখা
গেছে, চারদিক সুনসান নীরব। লোকজনের আনাগোনা নেই তেমন। নেই ঈদের আমেজ। শ্রমিকদের বসবাসের
স্থানগুলো ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।
চৈত্রের তপ্ত রোদের মধ্যে খালিশপুরের ক্রিসেন্ট
জুটমিলের সামনে চায়ের দোকানে কথা হয় সেখানকার একসময়ের অস্থায়ী শ্রমিক নাসিমা বেগমের
সঙ্গে।
নাসিমা বলেন, “অন্য কোনো কাজ জোটাতে পারি
নাই। কোনো পাওনা টাকাও পাইনি। অর্থকষ্টে পরিবার নিয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছি।
“দুই দিন বাদেই ঈদ। কিভাবে একটু সেমাই-চিনি
কিনব তা জানি না। কেউ দেখে না আমামের কান্না।”
কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে চোখের পানি মুছতে
থাকেন তিনি।
একই অবস্থার কথা জানান ৩৫ বছর বয়সী পারুল
বেগম।
পারুল বলেন, “২০০৯ সাল থেকে কাজ করছিলাম।
সে সময় প্রতি বৃহস্পতিবার ছিল অনেকটা উৎসবের মত। শ্রমিকরা মজুরি পেতেন ওই দিন। আর আজ
ঈদ উৎসবে মানুষের সাহায্যের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।“
তার স্বামীও পাটকলে কাজ করতেন।
পারুল বলেন, পাটকল বন্ধের পর তার স্বামী
রিকশা চালান। সেই আয়ে চলছে সংসার।
“আমার মতো শত শত শ্রমিক তাদের পাওনা বুঝে
পাননি। কাজ হারিয়ে তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন।”
খালিশপুরের প্লাটিনাম জুবিলি জুটমিলের শ্রমিক
ছিলেন আজাদুর রহমান। জুটমিলটির কলোনিতে পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। কারখানা বন্ধ হওয়ার
পর পাশেই ঘর ভাড়া নিয়ে আছেন।
আজাদ বলেন, “দুই যুগের বেশি সময় পাটকলে
কাজ করেছি। এখন অন্য কোনো ভারি কাজ করতে পারি না। বেকার বসে দিন গুনছি, ফের কবে মিল
চালু হবে।”
ওই কারখানার কলোনিগেটের নিরাপত্তাকর্মী
মো. রফিক মিয়া বলেন, পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কলোনিতে প্রতিদিনই দু-একজন ঘুরতে
আসেন। তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান দেখতে আসেন। অনেকে এসে চোখের পানি ফেলেন।
ক্রিসেন্ট জুটমিলের সর্বশেষ সিবিএ সাধারণ
সম্পাদক হেমায়েত উদ্দিন আজাদী।
আজাদী বলেন, “শ্রমিকরা এখনও আশা ছাড়েননি।
তারা চান সরকারি ব্যবস্থাপনায় আবার চালু হোক পাটকলগুলো। সেই আশাতেই খেয়ে না খেয়ে দিন
কাটছে তাদের।”