ক্যাটাগরি

বেনজেমার জাদু, বেনজেমার মৌসুম, বেনজেমার সময়

দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি তাকে নামানো হলো। ৪-০ গোলের জয়ে শেষ গোলটি এলো তার পা থেকেই। এর চেয়ে আদর্শ কিছু যেন আর হতে পারত না। যার কাঁধে চেপে শিরোপার পথে ছুটে গেছে রিয়াল মাদ্রিদ, তার গোলেই নিশ্চিত হলো শিরোপা জয়!

২০১০ সালে সেই সময়ের রিয়াল মাদ্রিদ কোচ জোসে
মরিনিয়ো বলেছিলেন, “বিড়াল দিয়েই শিকার ধরার অভিযানে নামতে হবে আমাদের, কারণ আমার কোনো
কুকুর নেই।” বেনজেমাকে সেই সময় ডাকা হতো ‘ক্যাট’ নামে। ইঙ্গিতটা ছিল তার দিকেই। কোচের
কথায় ছিল বাস্তবতার অসহায়ত্ব। সেই বেনজেমাই আজ রিয়াল মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় ভরসা।

অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতায় ম্যাচের পর ম্যাচ
তিনি টেনে নিচ্ছেন দলকে। ফ্রেঞ্চ ফরোয়ার্ডের অসাধারণ পারফরম্যান্সেই মূলত মিলেছে রিয়ালের
৩৫তম লিগ শিরোপা।

ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো রিয়াল ছাড়ার পর থেকেই
ক্লাবের ভার বয়ে নিচ্ছেন বেনজেমা। মাঠের পারফরম্যান্সে তিনি হয়ে উঠেছেন অবিসংবাদিত
নেতা ও সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারী খেলোয়াড়। রোনালদোর মতো একজনের শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব
নয় কখনোই। কিন্তু বেনজেমা যেমন নিজেকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়, তেমনি ক্লাবকেও জুগিয়েছেন
ভরসা।

রোনালদোর বিদায়ের পর প্রতি মৌসুমেই রিয়ালের
আক্রমণভাগের সেরা বেনজেমা। গোলমুখে তিনি হয়ে উঠেছেন ভয়ঙ্কর নিখুঁত এক ফিনিশার, যার
গোলের নেশা তীব্র। তবে নিজের আগের কাজও ভুলে যাননি একটুও। ঠিকই নিচে নেমে সতীর্থদের
পাশে থাকা, রক্ষণে সহায়তা ও আক্রমণে গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখার কাজ করে গেছেন সুনিপুণ
দক্ষতায়। অবিশ্বাস্য এক পরিপূর্ণ ফুটবলারের পরিণত হয়েছেন তিনি এই সময়ে।

লিগ শিরোপা জয় নিশ্চিত করার ম্যাচে গোল করে বেনজেমার উদযাপন। ছবি: রয়টার্স।

লিগ শিরোপা জয় নিশ্চিত করার ম্যাচে গোল করে বেনজেমার উদযাপন। ছবি: রয়টার্স।

পরিসংখ্যানে যদিও সব ফুটিয়ে তোলা কঠিন। তবে
কিছুটা ধারণা সেখান থেকে পাওয়া যেতে পারে। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৩০
গোল করেছিলেন তিনি, গোলে সহায়তা ছিল ১১টি, পরের মৌসুমে ২৭ গোলের সঙ্গে সহায়তা ১১টিতে,
গত মৌসুমে ৩০ গোলের পাশাপাশি সহায়তা ছিল ৯ গোলে। এবার ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে, অনেকটা
পেছনে ফেলেছেন চারপাশের সবাইকে।

সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এবার ৪২ ম্যাচে এই
মৌসুমে ৪২ গোল হয়ে গেছে তার। স্পেনের শীর্ষ পর্যায়ের অন্য যে কোনো ফুটবলারের দ্বিগুনের
বেশি গোল করেছেন তিনি একাই। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ, লা লিগার চার ম্যাচ বাকি আছে
এখনও।

লা লিগায় ২৬টি গোল করেছেন তিনি এখনও পর্যন্ত,
১৫টির বেশি করতে পারেননি লিগের আর কেউ। লিগে এবার রিয়ালের ৩৫ শতাংশ গোল করেছেন বেনজেমা
একাই। সঙ্গে ১১টি গোলে আছে সরাসরি সহায়তা।

১৮টি ম্যাচে রিয়ালের ম্যাচ জয়ী গোল করেছেন
তিনি। এখনও পর্যন্ত ক্লাবের ৮১ পয়েন্টের ৪৩ পয়েন্ট তিনি নিশ্চিত করেছেন ম্যাচের প্রথম
গোল বা ম্যাচ জয়ী গোলটি করে।

রিয়ালের সর্বকালের সফলতম গোলস্কোরারের তালিকায়
কিংবদন্তি আলফ্রেদো দে স্তেফানোকে (৩০৮) ছাড়িয়ে এই মৌসুমেই তিনে উঠে গেছে বেনজেমা।
রাউলকে (৩২৩) ছাড়িয়ে দুইয়ে উঠতে তার প্রয়োজন স্রেফ তার তিন গোল।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তার উন্নতির রথ ছুটছেই।
প্রতিনিয়তই যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন এই ৩৪ বছর বয়সেও। একসময় মাঠের পারফরম্যপান্সে
প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া যিনি ছিলেন তুমুল সমালোচিত, মাঠের বাইরে সেক্স টেপ কাণ্ডে নাম
আসা, ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচ দিদিয়ের দেশমের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ তুলে আলোচনার
জন্ম দেওয়া এবং নানা বিতর্কে নাম জড়ানো ফুটবলারটিই আজ সবকিছু পেছনে ফেলে পারফরম্যান্স
দিয়েই হয়ে হয়েছেন বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের একজন।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও শেষ ষোলো ও কোয়ার্টার-ফাইনালে
পিএসজি ও চেলসির মতো দুই ক্লাবের বিপক্ষে টানা হ্যাটট্রিক করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন,
সময় এখন তার।

রিয়ালের মহাতারকাদের আড়ালে একসময় টিমটিম করে
জ্বলতেন তিনি। আলাদা করে চোখে পড়ারও কারণ ছিল না। এখন তিনিই উজ্জ্বলতম। রিয়ালের হয়ে
সুদীর্ঘ ১৩ মৌসুমে জিতেছে চারটি করে লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি ও ক্লাব বিশ্বকাপের
ট্রফি, তিনটি ইউরোপিয়ান সুপর কাপ, দুটি কোপা দেল রে ও চারটি স্প্যানিশ সুপার কাপ। কিন্তু
এই মৌসুমের পারফরম্যান্সে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন সত্যিকারের গ্রেটদের কাতারে।

সময় এখন তার। এই মৌসুমও তার।

সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। মৌসুমও শেষ হয়নি।
অপেক্ষা তাই আরও বেনজেমা-জাদুর। তিনি নিজে যেমন লিগ শিরোপা জয়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
লিখেছেন, “বিশ্বের সেরা ক্লাবের আরও একটি ট্রফি, ৩৫তম লিগ শিরোপা। মৌসুমজুড়ে কঠোর
পরিশ্রমের জন্য দলকে অভিনন্দন, সমর্থকদের শুভেচ্ছ সমর্থনের জন্য… তবে আমাদের এখনও আরও
কিছু লক্ষ্য আছে…।”