সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের জাতীয় ঈদগাহে রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ঈদের নামাজ আদায় করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাধীনতার পর হাই কোর্ট এলাকার মাজারের পাশে সামিয়ানা টানিয়ে ঈদের নামাজ আদায় শুরু করেন স্থানীয়রা। বছর বছর সেখানে লোকসমাগম বাড়তে থাকে।
এখন যেখানে জাতীয় ঈদগাহ, সেই স্থানটি তখনও ছিল ঝোঁপজঙ্গল ঘেরা। তার পাশেই ছিল একটি বড় পুকুর। আশির দশকের শুরুতে সেই জঙ্গল কাটা শুরু হয়। ১৯৮৫ সালের দিকে পুকুরটি ভরাট করে এইচ এম এরশাদ সরকারের এক সিদ্ধান্তে স্থানটিকে জাতীয় ঈদগাহ মাঠ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এরপর থেকে সেখানে প্রতি বছর দুই ঈদে দেশের প্রধান ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
জাতীয় ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলির চিরচেনা এই দৃশ্য ২০১৮ সালে ঈদুল ফিতরের। ফাইল ছবি
জামাতের জন্য ঈদের এক থেকে দেড় মাস আগে থেকেই সরকারিভাবে এ ঈদগাহ মাঠের প্রস্তুতি কাজ শুরু হয়। প্রথমদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে ঈদ মাঠের প্রস্তুতির কাজ করা হলেও ২০০০ সালের পর থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে এই কাজ হয়ে আসছে।
হাই কোর্ট এলাকায় জাতীয় ঈদগাহ মাঠ হয়ে ওঠার বিষয়ে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করা ‘ঢাকা কেন্দ্র’র পরিচালক মোহাম্মদ আজিম বখ্শ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাই কোর্টের মাজার ও মসজিদকে কেন্দ্র করে সেখানে নামাজের বড় জামাত হত। যারা মসজিদ ও মাজারে যেতেন ও দেখাশোনা করতেন, তারা সেখানে ঈদের নামাজ আদায় করতেন। তাদের মধ্যে অনেক বিচারপতিও ছিলেন।
“হাই কোর্টের এই মাজার ও মসজিদ জাগ্রত হয়েছে ভারত বিভাজনের পর। বিশেষ করে যখন অবাঙালিরা এখানে আসল, তখন থেকে মাজার একটু জেগে বসল। হাই কোর্টের পাকা চত্বরেও ঈদের নামাজ হত। ওইখানে জমায়েত বাড়লেও আরও বড় করার জায়গা ছিল না। পরে ওইখানে সম্প্রসারিত করা হয়। এখানে একটা পুকুর ছিল, সেই পুকুর ভরাট করা হয়। বনজঙ্গলও ছিল, সেগুলো পরিষ্কার করা হয়।”
২০১৯ সালে জাতীয় ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ফাইল ছবি
জাতীয় ঈদগাহ মাঠের শুরুতে লোকসমাগম অতটা হত না জানিয়ে এই গবেষক বলেন, “আগে ঈদের বড় জামাত হত পল্টন, এখনকার আউটার স্টেডিয়ামে। অনেক পরে ঈদের জামাত শিফট হয়ে বর্তমান জাতীয় ঈদগাহ মাঠে হচ্ছে। এই ঈদগাহ জমজমাট হয়েছে গত ২০ বছর ধরে। তার আগে এত জমজমাট ছিল না।”
ঢাকায় ঈদের জামাতের ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে আজিম বখ্শ বলেন, “মুঘল আমলেও ঢাকার ধানমণ্ডিতে ঈদের জামাত হত। বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঈদের জামাত হলেও পাকিস্তান আমলে অনেক জায়গায় হত না। স্বাধীনতার পরে নাজিরা বাজার এলাকায় বাংলাদেশ মাঠে ঈদের নামাজ পড়া শুরু হয়।
“এছাড়া বংশাল এলাকার আহলে হাসিদের মতানুসাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে অনেক আগে থেকেই ঈদের জামাত পড়ে আসছে। এটাও পুরনো। সেখানে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও পর্দা দিয়ে আলাদাভাবে নামাজ পড়তেন।”
জাতীয় ঈদগাহ মাঠ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, “এটা বেসিক্যালি একটা বড় পুকুর ছিল। এই পুকুর ভরাট করে এরশাদের আমলে সেখানে মাঠ করা হয়। পরবর্তীতে সেখানে জাতীয় ঈদগাহ মাঠ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।”
দুই ঈদের সময় বাদে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি কর্মদিবসে জাতীয় ঈদগাহ ময়দান ভরে থাকে ব্যক্তিগত গাড়িতে। ফাইল ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
এই এলাকায় এই পুকুর ভরাট করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
“পুকুর যদি থাকত, তাহলে আশপাশের কোথাও আগুন লাগলে এখান থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজে ব্যবহার করা যেত। এমনিতেই ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বহু জলাধার ও খাল ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তাতে করে একটু বৃষ্টি হলেই বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে যায়।”
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত বছর ঈদের দিনে জাতীয় ঈদগাহ ছিল সুনসান। ফাইল ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
তবে মাঠ হওয়ার আগে এর আশপাশে কোনো ঈদ জামাত হত না বলে দাবি করেন আইনজীবী পান্না।
“মসজিদ-মাজার থাকলেও ঈদের জামাত সেখানে হত না, এর আশপাশে ঈদের জামাত হত একটা বাংলা একাডেমির ওইখানে, আরেকটি হতো কাকরাইলে। এরশাদ সরকার ক্ষমতা বলে সেখানে পুকুরটি ভরাট করে ফেলে।”