হ্যাঁ এই সাত সাগর আর তেরো নদীর এপার এ যুক্তরাজ্য থেকেই। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু এটাই বাস্তব ও পরম সত্য।
যুক্তরাজ্য এমনই একটি দেশ যার বহুজাতিক কর্মকাণ্ড বর্তমান বিশ্বে সত্যি বিরল। আর আমি থাকি তার খনি পূর্ব লন্ডনে। এ এলাকা মানে নিউহাম ও টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষের বহুমাত্রিকতার জন্যই লন্ডন ২০১২ সালের অলিম্পিক খেলার বিড জিতে নিয়েছিল।
এ শহরেরই টাওয়ার হ্যামলেটস নামের এমন এক সৃজনশীল বারায় আমি থাকি যেখানে ৫৫ শতাংশ এশীয় ও কৃষ্ণাঙ্গ, বাকিদের মধ্যে শুধু ১৮ শতাংশ সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ। এখন এই ৫৫ শতাংশের মধ্যে ৩২ শতাংশই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। আবার এই ৩২ শতাংশের ৪৩ শতাংশ বাংলাদেশিরই জন্ম এদেশে নয়। অর্থাৎ এরা সবাই ঠিক আমারই মতো জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। সুতরাং এখানেই সারা বিশ্বের মধ্যে ঘটা করে যে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হবে তা আর বিচিত্র কি!
ব্রিটিশ হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম
আমি প্রতিদিন আমার দ্বিভাষিক, দ্বিজাতিক কাজের ধারার মধ্যে একবার হলেও কোনও না কোনওভাবে হয় বাংলাদেশ, নয়তো বাংলা ভাষা, বা বাংলাদেশের পরিচিতি, অথবা যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করে একটা না একটা কাজ করেই চলেছি। সাংগঠনিক কাজ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী বক্তৃতা, পরামর্শ, লেখা, আলোচনা, কবিতা পারফরমেন্স, গল্প বলা- যাই হোক একটা কিছু হলেই হলো। বলা যায়, বাংলাদেশ নিয়ে যতো কাজ বৈশ্বিকভাবে এদেশে করেছি, তা দলবাজি তেলবাজি না করলে বাংলাদেশে পেতাম কিনা জানি না ।
কিন্তু একা কে কখন সফল হয়েছে বলুন? শুভবৃক্ষের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয় শুভ ও স্বচ্ছবুদ্ধি বিবেকসম্পন্ন মানুষের যুথবদ্ধ পরিচর্যা। আর তার গোড়ায় দিতে হয় স্থানীয় রাজনীতির সার। আমরা দেখেছি এমনকি বাংলাদেশেও সামাজিক চাহিদার একটি চাপ হয়তো সৃষ্টি করা যায়, কিন্তু তা পূর্ণ হয় তখনই যখন তা রাষ্ট্রীয় সমর্থন পায়।
এ প্রসঙ্গে আমরা জাতীয় পর্যায়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সময় শহীদ জননীর পদক্ষেপ এবং একুশকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য প্রবাসের আন্দোলনের কথা মনে করতে পারি। সামাজিক আন্দোলন কোনও বদান্যতা চায় না, চায় ন্যায্যতা। আর সে জন্যই স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিক, নেতা, শিল্পী, লেখক প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এতে তাদেরও অবস্থান ও সুদৃঢ় হয়।
‘প্রবাস পিতা’ নামে খ্যাত তসাদ্দুক আহমেদ
যুক্তরাজ্যকে তৃতীয় বাংলা বলার অন্যতম কারণই হলো মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পর যে দেশের অবদান– সে ছিল যুক্তরাজ্য। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু এ যুক্তরাজ্য হয়েই দেশে ফেরেন। এই ছিল বাংলাদেশের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ ঘাঁটি। আজও তার ব্যত্যয় হয়নি। এখানেই ঠিক বাংলাদেশের অনুরূপ বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিরোধীদের আবাসও। এবং বৈশ্বিক মৌলবাদের ধ্বজাধারী।
গত বছরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে কাউন্সিলের বছরব্যাপি অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সারা বছর ধরে তার উৎসবের শুরু হয় যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাঈদা মুনা তাসনিম পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র জন বিগসের হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেন।
সেই থেকে মেয়রের আগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় চলে সারা বছর ধরে তার উদযাপন। এ উদযাপন শুধু নানান আলোচনা ও নৃত্যগীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তা ছিল ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যেমন ঐতিহাসিক টাওয়ার ব্রিজ কিংবা লন্ডন আই থেকে শুরু করে বো টাউন হল অবধি লাল-সবুজ আলোকমালায় সাজানো। কিংবা হোয়াইট চ্যাপেল পাতাল রেল স্টেশনের নাম বাংলাভাষায় নাম লিখন পর্যন্ত। এ এক অভাবনীয় ব্যাপার। কিন্তু এ সবই শুধু প্রত্যক্ষ করা নয় বিগত ৩০ বছরে এসবের জন্মমূলে আমি ও বাংলাদেশের এক নগণ্য কবি রয়েছি বিছিয়ে- ভাবা যায়? যায় না।
কাউন্সিল ভবনে সুফিয়া কামালের পোট্রেট
১৯৭৮ সালে বর্ণবাদী আক্রমণে শহীদ হন বাংলাদেশের আলতাব আলী। স্থানীয়রা আন্দোলন ও লাগাতার প্রচেষ্টায় বাঙালি অধ্যুষিত হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় তার নামে এ পার্কের নামকরণ করতে সমর্থ হন। পরে সেখানেই নির্মিত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় স্থায়ী শহীদ মিনার। ঐতিহাসিক টয়েনবি হল এর আয়োজনে, স্বাধীনতা ট্রাস্ট্রের সহযোগিতায় আমি সারা দিনব্যাপি লন্ডনে বাঙালিদের পদচ্ছাপ আঁকা স্থানগুলো ঘিরে বাংলাদেশের গল্প বলার শুরুটাই করি আলতাব আলী পার্ক থেকে আমাদের একুশের গল্প দিয়ে।
মেয়র জন বিগস ২০১৫ সালে টাওয়ার হ্যামলেটস এর মেয়র হওয়ার পর যেদিন আলতাব আলী খুন হন সেই মে মাসের ৪ তারিখকে ‘শহীদ আলতাব আলী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেন। আর এখানে আমাদের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক বৈশাখী মেলা- যা কিনা চক্রান্ত করে বাংলা টাউন থেকে মাইলএন্ড পার্কে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বিগস তা আবার আমাদের ঘরে উইভার্স ফিল্ডে ফিরিয়ে দেন।
আমি শিক্ষকতা করতে যুক্তরাজ্যে এসেছিলাম। এখানকার বাঙালির ‘প্রবাসপিতা’ তসাদ্দুক আহমেদ আমাকে হাতে ধরে নিয়ে যান মূলধারার স্কুলগুলোয় যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘শাপলা’, ‘কাজী নজরুল’, ‘ওসমানী স্কুল’ নামে। ব্রিকলেইনে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখা ‘হোপ টাউন’ দেখে চোখে জল চলে আসে। একসময় লন্ডনে চার চারটি হাসপাতালের লিফটে বোতাম টিপলে ইংরাজির পাশাপাশি বাংলায় বেজে উঠতো আমারই কণ্ঠস্বর। সে আরেক গল্প, আরেকদিন করা যাবে। আমি বলছিলাম বিলেতে বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন নিয়ে।
হোয়াইটচ্যাপেল আইডিয়া স্টোরে (লাইব্রেরি ও লার্নিং সেন্টার) ‘বাংলা’ শব্দের এক অভাবিত আলোকসজ্জার চলে পুরো বছর। এতে দেশি শাড়ি ডিজাইনকে কাজে লাগিয়ে পুরো দালানের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে বিশাল এক ‘বাংলা’ শব্দ আর আলোকসজ্জার ঠিক নিচের দেয়ালে প্রদর্শনী হয় বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস।
গত বছর ওয়াপিং-এর একটি ভবনের নামকরণ করা হয় বর্ণ দাঙ্গায় শহীদ আলতাব আলীর নামে। এবছর করা হয় আরও চারটি কাউন্সিল ভবন ও একটি কর্নারের নামকরণ করা হয়েছে খ্যাতনামা বাঙালি ব্যক্তিত্বের নামে। এদের কারও অবদান এদেশে, কারো বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য দু-জায়গা মিলে এবং কারো শুধুই বাংলাদেশে কিন্তু তিনি বিশ্বজোড়া পরিচিত।
কাউন্সিল ভবনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের পোট্রেট
এরা হলেন- তাসাদ্দুক আহমেদ, শাহাব উদ্দিন আহমদ বেলাল, সুফিয়া কামাল এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এমনকি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কবি সুফিয়া কামালের বেলায় খ্যাতনামা শিল্পী মাশুক হেলালের আঁকা পোট্রেইট ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি ভবনের উন্মোচন চলবে ২০২২ জুড়ে।
বাংলা টাউন গেইটের পাশেই আশি দশকে বাংলা ও ইংরাজিতে লেখা ‘হোপ টাউনের’ সঙ্গে তার গায়ের দেয়ালে ব্রিটিশ বাংলাদেশি শিল্পী মোহাম্মদ আলী করেছেন ‘মাটির টানে ম্যুরাল’। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিমসহ স্থানীয় কাউন্সিলাররা। মাটির টানের আর্টিস্ট মোহাম্মদ আলী জানান, মূলত ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশের টান সেটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল বছরব্যাপী সমাপ্তি হয় এই ম্যুরাল উদ্বোধনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের নৌকা ও মাঝি, চা বাগান, সিলেটের ঐতিহাসিক কিন ব্রিজ সেখানে স্থ্যান পেয়েছে। বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের হোয়াইট চ্যাপেলর নামের পাশে বাংলা সাইন স্থাপনের পর বাংলা টাউনের গেইটে লাগানো হয় বাংলা সাইন।
আগামী ৫ মে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন। জন বিগসে নির্বাচনে প্রার্থী। কিন্তু এতকিছুর পরও কেউ কেউ বলছেন, তিনি সবকিছু নির্বাচনে জেতার জন্য, বাংলা ভোটের জন্য করেছেন। আমি বলি তাই তো করার কথা, তিনি বাঙালির জাতিসত্তার অবদান যাতে কোনদিন না হারায় এবং তারা যে মৌলবাদকে সমর্থন করে না তা জানান দিতে সাহায্য করেছেন। এবারের লড়াই মৌলবাদের সঙ্গে বহুজাতিকটা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার।
আমার নিজের কথা হলো তিনি নির্বাচিত হলে বাংলা ভাষা শিক্ষাকে বৈশাখী মেলার মতো ফিরিয়ে আনার কথা দিতে হবে।
লেখক: কবি ও কলামনিস্ট
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |