১৩ বছরের মেয়েটির নাম ফারজানা আক্তার ঝর্না। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার পাইকশা গ্রামের চতুর্থ শ্রেণির এ শিক্ষার্থী গত ছয় মাস ধরে ভর্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগে; লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত সে।
ঈদুল ফিতরের দিন দুপুরে হাসপাতাল থেকে দেওয়া সেমাই খেতে খেতে ঝর্না বলেন, “ডাক্তার স্যার জামা কিইন্না দিছে, ৫০০ ট্যাকা সালামিও পাইছি। কিন্তু আমার বাড়ি যাইতাম মন চায়। বাইবইন তারা বেবাকে বাড়িতে। হাসপাতালে আর ভালা লাগে না।”
ঢাকার মিরপুরে বাসিন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক আতিকুর বিশ্বাস মুকুলও দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন বিএসএমএমইউতে; সার্বক্ষণিক পাশে থাকছেন স্ত্রী। তার অসুস্থতা ভালোর দিকে, আশা করছেন শিগগির বাসায় ফিরতে পারবেন। তবে ঈদেও হাসপাতালে থাকতে হওয়ায় মন ভালো নেই তার।
সন্তান ও বাবা-মাকে বাসায় রেখে হাসপাতালে থাকতে ভালো লাগছে না তার।
“ঈদ আমাদের জন্য খুবই একটা আনন্দের বিষয়। খুশির দিনে যদি পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব পাশে না থাকে তাহলে ভালো লাগে বলেন!
“ঈদের দিন বাড়ির বাইরে কার মন টেকে বলেন! খুব লাগে। মনকে মানায়ে নিতে হয় অসুস্থ,” হতাশার সুরে বলেন তিনি।
এখানকার জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স বর্ণা বৈরাগী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখানে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের অনেকেই আত্মীয়স্বজনের মত হয়ে যান।
“অনেকে সার্জারির জন্য আসে, কেমোথেরাপির জন্য আসে। অনেকদিন থাকতে হয়- দুই বা তিন মাস, কখনও পাঁচ মাস। এজন্য তারা আমাদের পরিচিত হয়ে গেছে।”
ঈদের দিনেও রোগীদের ভিড় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। কিছুক্ষণ পরপরই দুর্ঘটনায় আহত রোগী আসতে দেখা গেল সেখানে।
সকাল বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগে ৬২ জন রোগী এসে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা স্বপন আহমেদের চার স্বজন দুর্ঘটনা আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন। তিনি জানান, বাড়ি যাওয়ার পথে বৃষ্টিতে দুর্ঘটনায় পড়ে উল্টে যায় আহতদের বহনকারী প্রাইভেটকারটি। আহতদের নিয়ে দৌড়াদৌড়িতে ঈদ আনন্দই মাটি হয়েছে তার; উল্টো দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার অনুপম দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঈদের দিনও জরুরি বিভাগে রোগীদের ভিড়। বেশিরভাগই দুর্ঘটনায় আহত।
“ঈদের সময় তার সহকর্মীদের অনেকে ছুটিতে আছেন। যারা ডিউটিতে আছেন তারা তিন শিফটে কাজ করেন। রোগীর চাপ বাড়লে যাদের ডিউটি নেই তাদেরও ডেকে আনা হয়। আসলে আমাদের চিকিৎসকদের ছুটি বলতে কিছু থাকে না আসলে। সব সময় যে কোনো পরিস্থিতিতে সেবা দিতে হবে- আমাদের এটা মাথায় সব সময়ই থাকে।”
আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছেলেকে নিয়ে গত ১৮ দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মুন্নী বেগম। ২০৮ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে।
হঠাৎ করেই তার আড়াই বছর বয়সী ছেলে মাহিন চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে; মাথা সোজা করতে পারে না। তখন হাসপাতালে ভর্তি করান তারা। ঈদ কিভাবে আসল, চলে গেল তা বোঝা হয়নি তার।
তিনি বলেন, “কিসের আর ঈদ হইব। বাচ্চা সুস্থ হইলে আবার ঈদ আইব, এইডাই আল্লাহর কাছে চাইতাছি। ডাক্তার কইছে অবস্থা আগের চাইতে ভালা।”
পটুয়াখালীর ২২ বছর বয়সী আকলিমা বেগম গত দেড় মাস ধরে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। সবশেষ স্ট্রোক করে চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়েছেন, কথাও বলতে পারেন না। নয় দিন আগে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আকলিমার মা, স্বামী ও দেবর সার্বক্ষণিক হাসপাতালে আছেন।
আকলিমার দেবর মোশাররফ হোসেন বলেন, “পরিবারের কেউ হাসপাতালে থাকলে ঈদ আর উদযাপন করা যায় না। তারপরও নামাজ পড়েছি। হাসপাতাল থেকে সেমাই, পোলাও মাংস দিয়েছিল তা খেয়েছি।”
মঙ্গলবার সকালে হাসপাতাল পরিদর্শন করতে এসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর ঈদের দিনে দায়িত্বপালন করা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ধন্যবাদ দেন।
তিনি বলেন, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা গত আড়াই বছর কোভিডের দায়িত্ব পালন করেছে। আজ ঈদের দিনও তারা কাজ করছেন।
“নিজের আত্মীয়স্বজন, পরিজনকে ছেড়ে এসে তারা রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। এখানে রোগীদের জন্য উন্নত খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। সব বিভাগের চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। এটা শুধু এখানে না দেশের সব হাসপাতালেই। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছে।”