অদূরে রাস্তায় সারি বেধে দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজি অটোরিকশা চালকদের যাত্রী খুঁজতে হাঁকডাকের মাঝে যেন ব্যতিক্রম তিনি। অটোরিকশার দরজা খুলে বাইরে দাঁড়িয়ে ঈদের আনন্দ উদযাপনরত মানুষের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন অনেকক্ষণ।
আশপাশ দিয়ে যাওয়া শিশুদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলারও চেষ্টা করছেন। যাত্রীর চেয়ে ওদের সঙ্গে আহ্লাদেই যেন আগ্রহ তার।
দূর থেকে ভেসে এল, “তোমার বেলুনটা তো খুব সোন্দর, দিবা আমারে?” তার বলার ভঙ্গিতে যেন কেমন ‘মায়া’- তাই তার কথায় বা খুনসুটিতে রাগ করছেন না শিশুদের বাবা-মাও।
কৌতুহলী হয়ে একটু এগিয়ে কথা হল তার সঙ্গে। নাম তার গোলাম মর্তুজা। বয়স ৬০ ছুঁইছুঁই। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায়।
কথা বলতেও বেশ আগ্রহীই হলেন- বললেন, “যেই বচ্ছর এরশাদশাহীর পতন হইল সেই বছর আমি ঢাকাত বেবি (টু-স্ট্রোক অটোরিক্সা) চালানো শুরু করলাম। এরপর যতদিন বাবা-মা বাঁইচা আছিল ঈদ পরবে বাড়িত গেছি। এহন এ গাড়ি চালায়া সংসার টানা অনেক কষ্টের। খায়া লয়া বাঁইচা থাকবার পারলেই আমাগো ঈদ।“
ফাঁকা ঢাকায় হাঁকাহাকি করেও যাত্রী মিলছে না
হাসপাতালে উপহার-সালামি, তবুও ‘কেমন কেমন লাগছে’ ঝর্নার
তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিনজনই বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়েছেন। বড় দুই ছেলে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। মেয়ের স্বামী টেক্সটাইল কারখানায়। ছোট মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে।
‘ঈদের বাজার’ ধরার জন্য বাড়ি যাননি জানিয়ে গোলাম মর্তুজা বলেন, “মাইয়ায় কইছিল আব্বা ঈদে বাড়িত আইও। আমি কথাও দিছিলাম। তয় এইবার জ্যাম-গরমের কারণে ঈদের আগে বাজার খুব খারাপ ছিল। গাড়ির জমা দিয়া খায়া-লয়া কুনো টাকাই হাতে আছিল না। বাড়িত গেলে তো ট্যাকার খরচা।
“জিনিসপত্রের যে দাম। এক কেজি গরুর মাংসের কেজি ৭০০ ট্যাকা। আমি এই গাড়ি সারাদিন চালায়া এহন ৭০০ ট্যাকা কামাইতে পারি না। ঈদের বাজারটা ধরমু এই কারণে বাড়ি পর্যন্ত গেলাম না।“
শুধু এ বয়জ্যেষ্ঠ চালক বাড়ি যাননি তা নয়, তার মত হাজারো সিএনজি অটোরিকশা চালক ঈদের দিন বাড়তি কিছু আয়ের আশায় রয়ে গেছেন উৎসব-উদযাপনের মায়া কাটিয়ে।
ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিকশা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি হাজী বরকতুল্লাহ বুলু জানান, একটা অটোরিকশার জন্য তিনজন করে চালক বরাদ্দ থাকেন। দুজন চালক সকাল-বিকেল পালা করে চালান। আর বদলি চালক সপ্তাহে দুদিন চার বেলা গাড়ি চালান। প্রতি ঈদে দুজন করে চালক বাড়ি গেলেও একজন করে থাকেন। ঈদের সময় ঢাকার কোনো গাড়ি বন্ধ থাকে না।
ঈদের দিন সব গাড়ি চলার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “ঈদের দিন ঢাকার অটোরিকশা মালিকরা জমা নেন না। এ বছর ঈদের আগের দিনও জমা দেননি বেশিরভাগ চালক। আর ঈদের দিন বাড়তি ভাড়া পাওয়া যায়। যার কারণে বাড়তি আয়ের জন্য চালকেরা ঈদের দিনেও গাড়ি চালাতে আগ্রহী হন।“
ঢাকা শহরে বাণিজ্যিকভাবে চালানোর জন্য অনুমোদনপ্রাপ্ত অটোরিকশা ১৫ হাজার ৬৯৬টি। এগুলো ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের গাড়িগুলোও ঈদের সময় বাড়তি আয়ের জন্য ঢাকায় ঢুকে বলে জানান বরকতুল্লাহ।
বিপুল সংখ্যক মানুষ রাজধানী ছাড়ায় এবারে ঢাকা অনেকটা ‘ফাঁকা’।
গত দুই বছর কোভিডের কারণে রোজগার কমে যাওয়ার পর এবার রমজান ও ঈদে বাড়তি আয়ের আশা করেছিলেন সিএনজি চালকেরা।
কিন্তু এবার রোজায় রোজগার একেবারে কম ছিল জানিয়ে সিএনজি মালিকদের ওই নেতা বলেন, “এইবার রোজায় যে জ্যাম। ড্রাইভাররা গাড়ি চালাইব কই। আগে আটটা-১০টা ট্রিপ দিলেও রোজার মাসে ট্রিপ হইছে চারটা-পাঁচটা।
“খুবই অবস্থা খারাপ ছিল এইবার। গাড়ির জমা দিতে হিমশিম অবস্থা।”
‘গাড়িতে আর সংসার চলতাছে না’
মালিকের কাছ থেকে চুক্তিতে একটা পুরনো টয়োটা গাড়ি (কার) ভাড়া নিয়ে উবারে চালান আশরাফ আলী। ঈদের দিন সকালে নামাজ পরেই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন। গভীর রাতে সাড়ে চার হাজার টাকা নিয়ে ঘরে ফিরতে পেরেছেন।
তিনি বলছেন, “এতদিন পর এই ঈদের দিন কয়টা ট্যাকার মুখ দেখলাম। রোজার শেষ কয়দিন তো গাড়ি বহায়াই রাখছি। বাইর হইলেই খরচা। কিন্তু একটা ট্রিপ ধরতে যাইতে যাইতেই এত সময় লাগে যে যাত্রী বিরক্ত হইয়া ক্যান্সেল কইরা দেয়।
“আবার এত সময় জ্যামে বইয়া থাকন লাগে গ্যাসের খরচ, গাড়ির খরচ দিয়া পোষান যায় না। তারচে গাড়ি না চালানই ভালো। আমাগো গাবতলী-মিরপুরের অনেক ড্রাইভারই তহন গাড়ি বহায় রাখছে। এহন গাড়িতে আর সংসার চলতাছে না।“
ঈদের বাজার ধরতেই অন্য আরও অনেকের মত তিনি এবার ঈদে গ্রামের বাড়ি যাননি।
তিনি বলেন, “করোনার সময় বাড়িত গিয়া রইছিলাম। ঢাকায় থাকলেই খরচ। বয়া থাকতে থাকতে গাড়িরও কাজ-কাম কম করাইতে হয়নি। সমিতি থিকা ঋণ করছি। ভাবছিলাম রোজায় সব পোষাইতে পারুম। কিন্তু হইল উল্টা, আরও দেনা হইছি।
“খালি ঈদের বাজারটা ধরমু বইলা বাড়ি গেলাম না। ঈদের দিন একেবারে খারাপ হয়নি।“
আর সিএনজি চালক মর্তুজা বলছেন, দিনে গাড়ির জমা দিতে হয় ৬৫০ টাকা। অথচ এখন এই গাড়ি চালিয়ে দেড় হাজার টাকা ভাড়া তুলতে কষ্ট হয়ে যায়। গ্যাসের খরচ আছে তিনশ টাকার মত। নিজের খাওয়া, মেসের ভাড়া সব মিলিয়ে হাতে তেমন টাকা থাকে না। আর রোজার মাস জুড়ে গাড়ির জমার টাকা, গ্যাসের খরচ দিয়ে হাতে তেমন কিছু থাকেনি।
ঈদের কেনাকাটা কিছু করেছেন কী না জানতে চাইলে ৩২ বছর ধরে ঢাকায় সিএনজি চালানো এ চালক বলেন, “আগে ঈদের আগে মার্কেট করতেই হইত। এহন পোলাপাইন বড় হইছে। আগের মতো খাটতেও পারি না। তাছাড়া এই গাড়িতে আগের চাইতে কামাই কমছে। যার কারণে এহন আর সাধ থাকলে ট্যাকা থাকে না। ভাবছিলাম একটা লুঙ্গি নিমু। ঈদ বাজারে দাম অত্যাধিক বেশি, ভাবলাম ঈদের পরেই বাইছা-বুইছা নিমু।“
ঈদের দিনেও তেমন ভালো খাবার জোটেনি জানিয়ে তিনি বলেন, “মেসে রাইতে ভালো খাওন আছে। দিনের বেলায় তো আমাগো রাস্তাতেই কাটে। আর জিনিসপত্রের যে দাম, গরীব মানুষ বয়লারের মুরগী ছাড়া আর খাইব কী। এহন এক বেলা ডিম দিয়া ভাত খাইতে গেলেও তো ৫০ টাকার নিচে হয় না।“
মীর হাজিরবাগের একটি গ্যারেজ থেকে তিন চাকার গাড়িটা ভাড়া নেন মর্তুজা। ঈদের দিন সকালে সেটি নিয়ে নিয়ে বেরিয়েছেন। একটা ট্রিপ মেরে ঈদের নামাজ পড়েছেন। এরপর বৃষ্টির মধ্যে আরেকটা ট্রিপ পেয়েছিলেন। তারপর অনেকটা সময় বসা।
ঈদের সারাদিন খেটেখুটে সন্ধ্যা ৮টায় তার পকেটে এক হাজার ৫০ টাকা। চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও একটা ভাড়া পেলেন না। পরে খালি গাড়ি নিয়িই গ্যারেজে ফেরার পথ ধরলেন তিনি।