মঙ্গলবার ঈদুল ফিতরের দিনে বৃষ্টি হলেও তা উৎসব উদযাপনে বড় বাধা হয়ে
দাঁড়াতে পারেনি। মহামারীর কারণে দুই বছর বিধি-নিষেধের মধ্যে ঈদ পার করার পর এবার ঈদে
বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না।
বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় ছিল বেশ, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার
পালাও ছিল। আর এর মধ্যে কয়েকটি দুর্ঘটনায় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার একটি
পার্কে রোলার কোস্টার থেকে পড়ে এক শিশুর মৃত্যু ঘটেছে।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসবের রঙ গত দুই বছর হারিয়েছিল করোনাভাইরাস
মহামারীর খাঁড়ায়। জাতীয় ঈদগাহে জামাতও হয়নি গত দুই বছরে চারটি ঈদে। মসজিদে ঈদ জামাত
হলেও বিধি-নিষেধের বেড়াজালে কোলাকুলির মতো চেনা দৃশ্যও স্বাস্থ্যবিধির তোড়ে গিয়েছিল
হারিয়ে।
জাতীয় ঈদগাহে মঙ্গলবার সকালে ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় মোনাজাত হয়। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
মহামারী পরিস্থিতির উন্নতিতে এবার আবার স্বরূপে ফেরে ঈদের উৎসব, জাতীয়
ঈদগাহে জামাতও হয়। ঈদের মোনাজাতে দেশের কল্যাণ কামনার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
রক্ষায় উসকানিমূলক বক্তব্য পরিহারের আহ্বান জানান ইমাম ও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের
খতিব মাওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমিন।
সম্প্রীতি রক্ষায় উস্কানিমূলক বক্তব্য পরিহারের আহ্বান ঈদ জামাতে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আভাস অনুযায়ী ঈদের দিন সকালেই আকাশে ছিল মেঘের খেলা,
তবে তা বৃষ্টি হয়ে ঝরেনি জাতীয় ঈদগাহে নামাজ শুরুর আগে। সেখানে ঈদের নামাজের পরপরই
নামে বৃষ্টি।
জাতীয় ঈদগাহে নামাজ শেষ হলেও ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার অনেক স্থানে নামাজের
মাঠেই বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে মুসল্লিদের। দমকা হাওয়াসহ সেই বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী না
হলেও তা শীতলতার পরশ বুলিয়ে যায় উৎসবে।
মহামারীর বিধি-নিষেধ পেরিয়ে কোলাকুলি আবার ফিরেছে ঈদে। জাতীয় ঈদগাহে মঙ্গলবার ঈদুল ফিতরের নামাজ শেষে এই কোলাকুলি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ঢাকা ছাড়াও টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট,
রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে। এসময় ঝড়ো হাওয়া ও বজ্রবৃষ্টি
হয়।
টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মেহেরপুর ও হবিগঞ্জে বজ্রপাতে সাতজনের প্রাণহানির
খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে তিনজন মারা যান নদীতে স্নানের সময়, একজন প্রাণ হারান বাবার
কবর জিয়ারতে গিয়ে, একজন মারা যান ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার পথে এবং একজন মারা যান পুকুর
স্নানের সময়।
ছবি-মেহেরপুর প্রতিনিধি
ঈদের দিন বজ্রপাতে চার জেলায় নিহত ৭
এদিকে ঢাকায় বৃষ্টির পর গরম কমে যাওয়ার পাশাপাশি ধুলোবালিও সরিয়ে দেয়।
এতে মানুষের বেড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়।
হাতিরঝিলের মনোরম পরিবেশে ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে আর গাছের ছায়ায় বসে
গল্প আর আড্ডায় দিন কেটেছে রাজধানীর হাজারও মানুষের। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সরগরম
ছিল পুরো ঝিল পাড়; একদল যাচ্ছেন তো দল বেঁধে আরেক দল আসছিল।
ঢাকার স্থায়ীদের বাসিন্দাদের পাশাপাশি যারা ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে
বাড়ি যেতে পারেননি কিংবা মেসে বা হোস্টেলে বসবাসকারী কর্মজীবী, শিক্ষার্থী কিংবা ঈদে
ঢাকায় আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা সব রকমের মানুষের দেখা মিলেছে হাতিরঝিলে।
ঝিলের গুলশান, এফডিসি ও রামপুরা প্রান্ত থেকে নৌকা বা স্পিড বোটে চড়ে
ভ্রমণের সুযোগ ছিল। তবে রামপুরা থেকে এফডিসি যাওয়ার সড়কের পুরো অংশজুড়ে বিনোদনপ্রেমীদের
দেখা গেছে ঝিলের পাশে বসে গল্প আর আড্ডায় মাততে। এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো আর ছবি বা সেলফি
তোলা ব্যক্তিরাও নজর কেড়েছেন।
এদিন বিকালের অনেকটা সময়জুড়ে কিশোর আর তরুণ বয়সীদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে
দল বেঁধে ঘুরতে আর হৈ হুল্লোড় করতে দেখা গেছে। তাদের অনেকেই জানালেন বন্ধুদের নিয়ে
অনেকটা সময় ‘এটাসেটা’ করে
সময় কাটিয়েছেন হাতিরঝিলে।
প্রাইভেটকার নিয়ে গুদারাঘাট প্রন্তে এসে থামা মোহন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর
ডটকমকে বলেন, “আমার সাথে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও
ছোট ছেলে রয়েছে। দুপুরের পর থেকে হাতিরঝিলে দুই চক্কর দিয়েছি। অন্যান্য প্রান্তে পার্কিংয়ের
ভালো সুযোগ না পেয়ে এ ঘাটে এসে থামলাম নৌকা ভ্রমণের জন্য।
“ঢাকায় বিভিন্ন রকম বিনোদনকেন্দ্র থাকলেও প্রকৃতিক
পরিবেশ পাওয়া যায় কেবল হাতিরঝিলে। এছাড়া চিড়িয়াখানারও একটা ভিন্ন আবেদন রয়েছে। তবে
এবার ঈদের দিনে ভিড়বাট্টা কম হওয়ায় বেশ স্বস্তিতে ঘুরেছি আমরা। এখন একটুখানি বোটে উঠার
ইচ্ছে আছে।”
ভিড় ছিল সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউতে, চন্দ্রিমা উদ্যান ও লেকরোড
এলাকায়, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরেও। নতুন জামাকাপড় পরে সেজেগুজে মানুষ সকাল থেকেই
ভিড় জমায় চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকায়। সন্ধ্যা ৮টার দিকে পুলিশ বাঁশি ফুঁকে উদ্যান থেকে
লোকজনে বের করে দেয়। এসময় কেবল ফুটপাথে লোকজনকে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া
হয়, লেকের পাড়ে নামলেই বাঁশি ফুঁকছিল পুলিশ।
চন্দ্রিমা উদ্যানে ঘুরতে আসা মরিয়ম নেছা বলেন, “এবার
গ্রামে যাওয়া হয়নি। গ্রামের ঈদে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করতে, বন্ধুদের
সঙ্গে আড্ডা দিতেই দিন পেরিয়ে যায়। কিন্তু ঢাকায় যে বন্ধুরা ছিল সবাই বাড়ি গেছে। তাই
মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে আসতে হলো চন্দ্রিমা উদ্যানে।”
এর মধ্যেই রাজধানীর শ্যামপুর ইকোপার্কে রোলার কোস্টার থেকে নিচে পড়ে
রাব্বী নামে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী মারা যায়। বলা হচ্ছে, রোলার কোস্টার চলার
সময় শিশুটি সিট বেল্ট খুলে ফেলায় পড়ে গিয়ে মারা যায়।
ঢাকায় রোলার কোস্টার থেকে পড়ে শিশুর মৃত্যু
দুর্ঘটনা-সংঘাত
ঈদ মানে যেমন আনন্দ, কিন্তু গত কয়েক বছরে সড়কে মৃত্যু সেই উৎসবকে ম্লান
করেছিল। এবার ঈদযাত্রা ঝামেলাহীন এবং অনেকটাই দুর্ঘটনাহীন হলেও ঈদের দিনে কয়েকটি দুর্ঘটনায়
নিহত হয়েছে কয়েকজন।
এর মধ্যে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুরে বিকালে এক স্থানে দুটি
সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। সফিপুর উড়ালসড়কের পূর্বপাশে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে সালনা
(কোনাবাড়ি) হাইওয়ের ওসি মো. ফিরোজ হোসেন জানান।
নিহতরা হলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাদুল্লাপুর গ্রামের মৃত আলতাব
হোসেনের স্ত্রী রেণু বেগম (৫০), গাজীপুরের দক্ষিণ সালনার রমিজ উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ
হোসেন (৪৫), জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সানন্দবাড়ী গ্রামের সাথী আক্তার (২৫), শরিফ
হোসেন (২৮) এবং অজ্ঞাত পরিচয় (৪৫) একজন।
ওসি ফিরোজ হোসেন জানান, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের সফিপুর উড়ালসড়কে পূর্বপাশে
মহাসড়ক পার হওয়ার সময় একটি অটোরিকশার সঙ্গে উত্তরবঙ্গগামী এনা পরিবহনের একটি বাসের
সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান চারজন।
এ দুর্ঘটনার ৫ মিনিট পরেই ওই ঘটনাস্থল থেকে অল্প দূরে সফিপুর ফ্লাইওভারের
নিচে তাকওয়া পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংঘর্ষ হয়। এতে মো. হোসেন
মারা যান।
এদিকে শরীয়তপুর সদরে ঈদের নামাজ পড়া নিয়ে দুটি পক্ষের সংর্ঘষের মধ্যে
ধারালো অস্ত্রের আঘাতে একজন নিহত হন; আহত হন অন্তত ১৯ জন। পালং মডেল থানার ওসি মো.
আকতার হোসেন জানান, মঙ্গলবার সকালে চিতলীয় ইউনিয়ন পরিষদ সমজিদের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত কুদ্দুস বেপারী (৭০) মীরকান্দা গ্রামের মৃত রহমানের ছেলে। আহতদের
মধ্যে জয়নাল বেপারী (৪৫) ও শহীদ সরদার (৪০) নামের দুইজনকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানো
হয়েছে। বাকিদের শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অন্যদিকে পূর্ব বিরোধের জের ধরে কুমিল্লা সদর উপজেলায় ঈদ জামাতের মাঠে
প্রকাশ্যে এক ব্যক্তিকে গুলি করা হয়। মঙ্গলবার সকাল ৮টায় উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের
ভারত সীমান্তবর্তী গোলাবাড়ি এলাকার ঈদগাহ মাঠে এ ঘটনা ঘটে বলে কোতোয়ালি মডেল থানার
ওসি সহিদুর রহমান জানান।
গুলিবিদ্ধ মোস্তাক আহমদকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা
হয়েছে। তিনি গোলাবাড়ি এলাকারই বাসিন্দা।
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঈদের দিন
দুপুরে স্থানীয় প্রভাবশালী দুপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে দুজন নিহত হন, আহত হন
আরও ১০ জন।
মঙ্গলবার দুপুর ২টায় উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের গোহাইলবাড়ী বাজার এলাকায়
এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে সহকারী পুলিশ সুপার (মধুখালী-বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গা সার্কেল)
সুমন কর জানান।
নিহতরা হলেন- উপজেলার চরদৈত্যকাঠি গ্রামের হাসেম মোল্যার ছেলে আকিদুল
মোল্যা (৪৬) এবং একই গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে খায়রুল ইসলাম (৪৫)।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে সহকারী পুলিশ সুপার বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে
কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রভাবশালী মোহাম্মদ মোস্তফা জামান সিদ্দিক এবং আরিফুর হোসেনের
সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ঘটনাস্থলেই দুজন
নিহত হন। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।