ক্যাটাগরি

লাখো দর্শনার্থীর ভিড়ে চিড়িয়াখানার ‘ভিন্ন একদিন’

লাখো মানুষের উপচে পড়া ভিড় বুধবার এতটাই বেড়েছিল যে হুড়োহুড়িতে বাবা-মায়ের কাছ থেকে দলছুট হয়ে গিয়েছিল ৭০ দর্শনাথী, যাদের বড় অংশই ছিল শিশু। অভিভাবকদের কাছ থেকে তারা দূরে সরে গেলে কিছু সময়ের জন্য আনন্দ রূপ নেয় দুশ্চিন্তায়। তবে চিড়িয়াখানার মাইকে একের পর এক ঘোষণার পর দিনশেষে সবারই দেখা হয়েছে অভিভাবকদের সঙ্গে বলে জানিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।

ভিড়ের চিত্র বোঝাতে গিয়ে চিড়িয়াখানার পরিচালক মুজিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ের কারণে বিকালে বেশ কয়েকবার টিকেট পরীক্ষা বাদ দিয়েই প্রধান ফটক খুলে দিয়ে গণহারে ঢোকার সুযোগ দেওয়া হয়।“

কোভিড মহামারীর কারণে দুই বছর বিরতির পর মুক্ত পরিবেশে ঈদ আনন্দ উদযাপনে ঈদের পরের দিন সকাল থেকেই রাজধানী বিভিন্ন এলাকা থেকে মিরপুরমুখী হয়েছেন অনেকেই।

ঈদের পরদিন মিরপুর চিড়িয়াখানায় জেব্রা দর্শন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঈদের পরদিন মিরপুর চিড়িয়াখানায় জেব্রা দর্শন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

লক্ষাধিক দর্শনার্থীর ভিড় এতটাই বেড়েছিল, দুপুরের পর থেকে হাজার হাজার মানুষকে চিড়িয়াখানার পথে যেতে মিরপুর-১ নম্বর চত্বর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটেই যেতে দেখা গেছে। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না।

চিড়িয়াখানায় আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে উত্তরা, হাজি ক্যাম্প, পুরান ঢাকা, শ্যামপুর, বাড্ডা, কদমতলীসহ ঢাকার আশপাশের জনপদ থেকে পরিবারের ছোটবড় সদস্যদের নিয়ে চিড়িয়াখানার দিকে আসতে থাকেন মানুষজন।

মহামারীর বিধিনিষেধের কারণে প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর (মাঝে কয়েকমাস সীমিত পরিবেশে খোলা ছিল) গত ২৭ অগাস্ট দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় মীরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানা। তবে এর মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি পালন করার নানা কড়াকড়িতে দর্শনার্থী ছিল সীমিত।

মহামারীতে চারটি ঈদ কেটে যাওয়ার পর এবার রোজার ঈদেই প্রথম বিধিনিষেধ ছিল না। মঙ্গলবার ঈদের দিনে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছিলেন ৩৫ হাজার দর্শনার্থী। তবে পরদিন যেন ছিল বাঁধভাঙ্গা মানুষের ঢল।

চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসা অন্তত ১০ জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ৮ জনই জীবনে প্রথমবারের মতো এখানে ঘুরতে এসেছেন।


ঈদ লেগেছে হাতিরঝিলে
 


ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে সেই চিরচেনা ভিড়
 

চিড়িয়াখানার পরিচালক বলেন, আমি চিড়িয়াখানার অনেক পুরোনো কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সবারই একই কথা যে- এরকম জনসমাগম তাদের চাকরি জীবনে তারা দেখেননি।

“গেইটে টিকেট বিক্রির দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকেও আভাস দেওয়া হয়েছে- আজকের দর্শনার্থী এক লাখের অনেক বেশি হবে।“

ঈদের পরদিন বুধবার ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানার প্রবেশ করতে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ সারি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঈদের পরদিন বুধবার ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানার প্রবেশ করতে দর্শনার্থীদের দীর্ঘ সারি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, অভিভাবকের হাত থেকে ছুটে গিয়ে ৭০ জনের মত শিশু হারিয়ে গিয়েছিল। সবাইকে শেষ পর্যন্ত খুঁজে বের করা গেছে। মোড়ে মোড়ে আমাদের কর্মীরা ছিল। তারা মাইকে ঘোষণা করে শিশুদেরকে তাদের অভিভাবক খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে।

ভিড়ের কারণে চিড়িয়াখানার মূল গেইটের বাইরে অনেক দোকানের খাবার দুপুরের পর শেষে হয়ে যায়। বেশ কয়েকটি পান দোকানের পানও শেষ হয়ে যায়। তাদের ধারণাও ছাপিয়ে গেছে এবারের ভিড়।

ঈদ উপলক্ষে চিড়িয়াখানা এলাকায় আইনশৃ্ঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ ক্যাম্প দেখা গেছে। তবে মিরপুর-১ নম্বর চত্বর থেকে চিড়িয়াখানার গেইট পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা, ফুটপাতের দোকান-পাট ও দর্শনার্থীদের ভিড়ের কারণে পুরো এলাকায় স্থির হয়ে দাঁড়ানোর পরিস্থিতি ছিল না।

চিড়িয়াখানার পরিচালক মুজিবুর বলেন, অধিক দর্শনার্থী সামাল দিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত উপস্থিতি ছিল। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার কথা আমাদের কানে আসেনি। কারও কোনো কিছু খোয়া গেছে এমন কিছু শুনি নাই।

ঈদের পরদিন বুধবার বাবার কাঁধে চড়ে মিরপুর চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল এ শিশুকে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঈদের পরদিন বুধবার বাবার কাঁধে চড়ে মিরপুর চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল এ শিশুকে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

তিনি বলেন, “তবে বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল অবস্থা হয়েছিল। দর্শনার্থীরা ভেতরে ঢুকতে না পেরে তীব্র রোদের মধ্যে প্রধান ফটকের বাইরে অবস্থান নিয়েছে।

“আমরা ইজারাদারদের সঙ্গে কথা বলে কয়েকবারের জন্য প্রধান ফটক খুলে দিয়ে ভিড় কমানোর চেষ্টা করেছি। ওই সময় টিকেট চেকিংটা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত টিকেট দেওয়া হয়েছে; যদিও অন্য সময় তা বিকাল ৫টা পর্যন্ত দেওয়া হয়। আশা করছি কেউ চিড়িয়াখানায় এসে ব্যর্থ হয়ে ফেরত যায়নি।“

বিমানবন্দর হাজী ক্যাম্প এলাকা থেকে আসা গৃহিণী নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, ঈদের ছুটিতে ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যায়। কিন্তু চিড়িয়াখানায় এসে এতো ভিড়ের মধ্যে পড়ে তার ধারণা পাল্টে গেছে।

“জীবনে এবারই প্রথম বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসলাম। কিন্তু এখানে এত মানুষ দেখে মনে হয় না মানুষ ঢাকা ছেড়েছে। চিড়িয়াখানাতেই মনে হয় কয়েক লাখ মানুষ চলে এসেছে,” বলেন তিনি।

অনেক দর্শনার্থীকে দেখা গেছে ঝুঁকি নিয়ে একটি মোটরসাইকেলে পরিবারের চার সদস্যকে বসিয়ে চলে এসেছেন চিড়িয়াখানায়।

মিরপুর চিড়িয়াখানায় জিরাফ দেখছেন দর্শনার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

মিরপুর চিড়িয়াখানায় জিরাফ দেখছেন দর্শনার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এমনই একজন রাজধানীর পুরান ঢাকার বাসিন্দা আতাউর রহমান। প্রায় ৪০ এর কোটায় পৌঁছে যাওয়া এই ব্যক্তি চাকরি করেন রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানায়। বাজাজ ডিসকভার ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলে সামনে তেলের ট্যাংকে বসিয়েছেন ৪ বছর বয়সী ছেলেকে। মোটরসাইকেলের পেছনে বসেছেন আতাউরের স্ত্রী ও স্কুল পড়ুয়া মেয়ে।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যানজটের ঝক্কি এড়াতে পরিবারের সবাই মিলে একটু রিস্ক নিয়ে একই মোটরসাইকেলে চলে আসলাম। কিন্তু এখন যেই ভিড় দেখতে পাচ্ছি তাতে আসার কষ্টের চেয়ে ভেতরে ঢুকার কষ্ট মনে হচ্ছে আরও বেশি হবে।“

চা-পান-সিগারেট বিক্রেতা আব্দুল্লা আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চিড়িয়াখানার পাশে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সেই তার জন্ম ও বেড়ে উঠা। পাশে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করলেও ঈদ উপলক্ষে চা ও পানের পসরা নিয়ে ফুটপাথে বসেছেন তিনি। বেলা ৩টার দিকে পানের মজুদ শেষ। ভিড়ের কারণে আবার কোথাও থেকে পান কিনে নিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এত মানুষের ভিড়ে চিড়িয়াখানার ভেতরের অবস্থাও খুব একটা স্বাভাবিক ছিল না। যারা শখ করে আর অনেক আশা নিয়ে পছন্দের প্রাণীদের দেখতে এসেছিলেন তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি। শিশুদের হতাশ হতে হয়েছে বেশি। ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কিতে প্রাণীদের খাঁচাগুলোর খুব একটা কাছে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।