ক্যাটাগরি

জুমভূমিতে আগুন: ‘খাদ্য সংকটে’ লামার ৩ পাড়ার ৩৬ পরিবার

বন থেকে সংগ্রহ করা জঙ্গলি আলু, কলার নরম অংশ বুগলি, লতাপাতা ও শাকসবজি খেয়ে কোনোরকমে দিন পার করার কথা বলেছে সেখানকার দুটি ম্রো এবং একটি ত্রিপুরা পাড়ার মোট ৩৬টি পরিবার।

শুক্রবার সরেজমিনে গেলে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, ২৬ এপ্রিল জুমভূমি পুড়িয়ে দেওয়ার পর তারা খাদ্য সংকটে পড়েছেন। কোনো কোনো পরিবার একবেলা বা দুবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি। জমি পোড়ানোর পর থেকে পাড়ার অধিকাংশ পুরুষ কাজ না পেয়ে অলস বসে আছেন। কেউ কেউ দূরে দিনমজুরিতে গেছেন। কেউবা দূরের বন-জঙ্গলে গেছেন তরকারি সংগ্রহ করতে।

লাংকম ম্রো পাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়া ও রেংয়াং ম্রো পাড়ায় বাসিন্দারা বলেন, জুম চাষের জমি ও বাগান থেকে বাঁশ ও কাঠ কেটে, শাকসবজি ও বিভিন্ন ফলমূল সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে তারা চলতেন। কিন্তু সেই জমি, বন, গাছ, ফলদ বাগান সবকিছু পুড়ে যাওয়ায় এখন সংকট তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া তারা বাজারে যেতেও ভয় পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

খাবার সংকটের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, জুমচাষের জমি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি ও মামলা হয়েছে। আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।

জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার এবং লামা উপজেলা সদর থেকে থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সরই ইউনিয়ন। ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ওই তিনটি পাড়া।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি এলাকায় ৩০০ একরের বেশি জমিতে আগুন দিয়ে দেয়। এতে বিশাল এলাকা বিরানভূমিতে পরিণত হয়।

তবে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দিন দাবি করেন, “এই জমি লিজ নেওয়া হয়েছে। সেখানে রাবার চারা ও কাজু বাদাম লাগানোর জন্য জঙ্গল কেটে আগুন লাগানো হয়েছিল। এতে পাড়াবাসীর কারও কোনও ঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সবার ঘর অক্ষতই আছে।”

লাংকম ম্রো পাড়ার বাসিন্দা চওরাও ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরিবারে চার বছরের ছেলে ও দুই বছরের মেয়ে রয়েছে। বাচ্চাদেরই তিন বেলা খাওয়ানো হয়। স্বামী-স্ত্রী খাদ্য সংগ্রহ করতে পারলে একবেলা, দুবেলা করে খান।

“তাও জঙ্গলের লতাপাতা, কলার নরম অংশ বুগলি ও কিছু শাকসবজি দিয়ে খাচ্ছি। সকালে বাকিতে এক কেজি চাল পেয়েছি। রান্না করে পরিবারে চার সদস্য সকাল এবং দুপুরবেলা খেয়েছি। কিন্তু রাতের জন্য আর কোনো খাবার নেই।”

একই পাড়ার বাসিন্দা রেংচং ম্রো বলেন, তার ঘরেও কোনো খাবার মজুত নেই। দেড় বছর বয়সী মেয়েটাও কয়েক দিন ধরে অসুস্থ। জ্বর ও কাশিতে ভুগছে।

রাবার কোম্পানির লোকজনের ভয়ে বাজারেও কেউ যেতে পারে না বলে অভিযোগ করেন ইংচং ম্রো।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটককমকে বলেন, “পাড়া থেকে সরই ইউনিয়ন সদরে কেয়াজু বাজারের দূরত্ব পাঁচ-ছয় কিলোমিটার হবে। পাড়াবাসীর কেউ ভয়ে সেখানে যান না। রাবার কোম্পানির লোকজন আমাদের তিন পাড়ার কাউকে দেখলে মারার হুমকি দিয়েছে।”

১৩টি পরিবার নিয়ে লাংকম ম্রো কারবারি পাড়া। এই পাড়ার প্রধান (কারবারি) লাংকম ম্রো নিজেই।

তার ঘরে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরে তার স্ত্রী আধা কেজি চাল রান্না করছেন। তরকারি হিসেবে রয়েছে ছোট ছোট বাঁশকরুল ও জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা শাক। রান্না শেষে এই তরকারি দিয়ে প্রথমে তার বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়।

পাড়াপ্রধান লাংকম ম্রো বলেন, “রাবার কোম্পানি আমাদের জুমভূমি ও বাগানে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পর বাঁশ ও কাঠ কেটে বিক্রি করারও সুযোগ নাই। মজুরি করার জায়গাও দূরে। পাড়ার লোকজন এমনিতে গরিব হলেও না খেয়ে থাকতে হতো না। এখন খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়।”

“এক সপ্তাহ আগে আড়াই হাজার টাকার বাজার করলাম। এক হাজার দিয়েছি। আরও দেড় হাজার টাকা দোকানে বাকি রেখেছি। টাকা নাই দেখে দোকানদারাও আর বাকিতে দিতে চায় না।”

এদিকে রেংয়াং ম্রো পাড়ার কারবারি রেংয়াং ম্রো বলেন, তার পাড়ার ১১টি পরিবারেই কারও খাবার নেই। সবারই মারাত্মক অভাবে আছে। দূরে গিয়ে বিভিন্ন এলাকায় দিনমজুরি করে। কোনোরকমে খেয়ে থাকে।

“আগে তিনবেলা খেতাম। এখন কেউ একবেলা, কেউ দুবেলা খেতে পায়। পাড়ার কোনো পরিবারের তিনবেলা ভাত খাওয়ার সামর্থ্য নেই। কেউ কেউ কোয়ান্টাম এলাকায় গিয়ে দিনমুজরি করলে ৩৫০ টাকা পায়। কোয়ান্টাম ছাড়া অন্য কোথাও গিয়ে দিনমজুরি করারও সুযোগ নাই। জায়গাগুলো অনেক দূরে।”

রেংয়াং ম্রো আরও জানান, তার পরিবারে ১৪ জন সদস্য রয়েছে। তার মধ্যে ছয়জনই শিশু। খাবার সংকটে পড়ে চাষের জন্য রেখে দেওয়া জুম ধানের বীজও রান্না করে খেয়ে ফেলা হয়েছে।

জয়চন্দ্র ত্রিপুরা পাড়াতেও ১২টি পরিবারের সবাই খাবার সংকটে আছে বলে জানান পাড়াপ্রধান।

সরই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মেনওয়াই ম্রো বলেন, “ঈদ উপলক্ষে কিছু রিলিফের চাল পেয়েছিলাম। সেখান থেকে জয়চন্দ্রের পাড়ার মাত্র ছয় পরিবারকে কিছু চাল দেওয়া গেছে। এখন আরও চেষ্টা করা হচ্ছে অন্যান্য পরিবারকে আরও কিভাবে দেওয়া যায়।”

তবে ডলুঝিরি মৌজার হেডম্যান জোহন ত্রিপুরা বলেন, ওই ৪০০ একর এলাকায় তিন পাড়াবাসী দীর্ঘদিন ধরে জুম চাষ করে আসছিলেন। ২০২১ সালে এসে একটি রাবার কোম্পানি সেটিকে তাদের লিজের জায়গা বলে দাবি করে।

“কিন্তু আমার তজিভুক্ত জায়গায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে কোনো জায়গা নেই।”