ক্যাটাগরি

মেট্রো রেল: উত্তরা টু আগারগাঁওয়ের ৯ স্টেশন সাজছে যেভাবে

এভাবেই স্বয়ংক্রিয় আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে সাজানো হচ্ছে রাজধানী ঢাকায় মেট্রো রেলের স্টেশনগুলো।

ঈদের আগে উত্তরা অংশে ‘উত্তরা উত্তর’ স্টেশন ঘুরে দেখার সময় স্টেশনের মূল অবকাঠামো নির্মাণ শেষে এখন সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি আর সরঞ্জাম লাগাতে দেখা গেছে।

স্বপ্নের এ মেট্রো রেল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আংশিক চালু করতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নয়টি স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলীর সঙ্গে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে গড়ে তোলা হচ্ছে যাত্রী ব্যবস্থাপনার কাজ। এসব স্টেশনে যাত্রী ব্যবস্থাপনা করা হবে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে; যাত্রী চলাচলে থাকবে সব ধরনের নিরাপদমূলক ব্যবস্থা।

মেট্রোরেল বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টা স্টেশনের এক্সিট, এন্ট্রি, টিকেটিং মেশিনসহ যত ধরনের যন্ত্রপাতি লাগবে সব কিছুই চলে এসেছে। এখন লাগানো শুরু হয়েছে।

এসব যন্ত্রপাতি লাগানোর জন্য বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, “উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ট্রায়ালও দেওয়া হয়েছে। আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের আগেই এই নয় স্টেশনের সকল কাজ শতভাগ শেষ হয়ে আমরা যাত্রী পরিবহনের জন্য শতভাগ প্রস্তুত হয়ে যাব।”

আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে উত্তরা থেকে আগাঁরগাও এবং আগামী বছরের ১৬ ডিসেম্বর মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেল চালু করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।

উত্তরা থেকে মতিঝিল: স্টেশন ১৭টি

সবশেষ কাজের অগ্রগতি অনুযায়ী, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটারের এ উড়াল রেল প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রায় ৭৮ শতাংশ এবং উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের বাস্তবায়ন হয়েছে প্রায় ৯২ শতাংশ।

মেট্রো রেলের উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশে থাকবে ১৭টি স্টেশন; এগুলোর মধ্যে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ের শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে এখন।

বর্তমান যে নয়টি স্টেশনের শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে সেগুলোর মধ্যে উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরে অবিস্থত উত্তরা উত্তর স্টেশনের কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি বলে জানালেন প্রকল্পের উপ ব্যবস্থাপক মো. মাহফুজুর রহমান।

স্টেশন সাজানো হচ্ছে যেভাবে

উত্তরা উত্তরা স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, নিচ থেকে স্টেশনের দুই পাশ দিয়ে ‘কনকোর্স’ (মেট্রো রেল স্টেশনে ঢোকার আগের স্থান যেখানে টিকেট কাউন্টার, টিকেট ও নিরাপত্তা যাচাই করা হয়) লেভেলে উঠানামার জন্য সিঁড়ি, লিফট ও এস্কেলেটর রয়েছে।

এসব সিঁড়ি, লিফট ও এস্কেলেটর ব্যবহার করে ট্রেন চলাকালীন সময়ে কনকোর্স লেভেল দিয়ে রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়া যাবে।

নিচ থেকে দোতলায় বা কনকোর্স লেভেলে উঠে দেখা যায়, ১৮০ মিটার প্রশষ্ত কনকোর্স লেভেলে যাত্রীর টিকেট সংগ্রহের জন্য রয়েছে এক পাশে দুটো করে মোট চারটি টিকেট কাউন্টার এবং দুটি টিকেট ভেন্ডিং মেশিন অফিস।

সুপরিসর এ জায়গার মাঝখানে বসানো হচ্ছে প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা টিকেট কাউন্টার। এর পাশে রয়েছে অনিয়ম বা বিনা টিকেটে ভ্রমণকারীদের জরিমানা আদায়ের আলাদা কক্ষ।

স্টেশনের দুই পাশে নারী ও পুরুষের জন্য চার কোনায় চারটি আলাদা টয়লেট জোন। রয়েছে আলাদা নামাজের কক্ষ।

উত্তরার এ স্টেশনে রয়েছে রেল চালকদের জন্য আলাদা বিশ্রামাগার এবং প্রকৌশলীদের জন্য আলাদা কক্ষ।

স্টেশনের টিকেট অফিস মেশিন (টিওএম) থেকে বিক্রয় কর্মীর সহায়তায় প্রতিবার ভ্রমণের পাশাপাশি মাসভিত্তিক বা বার্ষিক টিকেট বা পাস সংগ্রহ করা যাবে। এর পাশাপাশি রয়েছে টিকেট ভেন্ডিং মেশিন, যেটি থেকে যাত্রী স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাহিদা অনুযায়ী টিকেট সংগ্রহ করতে পারবেন।

কর্মকর্তারা জানান, টিকেট সংগ্রহের আগে পর্যন্ত যাত্রী যেখানে থাকবেন, সেটা হবে স্টেশনের ‘নন পেইড’ এলাকা। যাত্রী মেশিনে টিকেট পাঞ্চ করে চলে যাবেন ‘পেইড’ এলাকায়। নির্ধারিত মেশিনে টিকেট পাঞ্চ ছাড়া কেউ পেইড জোনে যেতে পারবেন না।

এরপর যাত্রী পেইড জোন থেকে সরাসরি তিন তলায় অবস্থিত প্ল্যাটফর্মে যাবেন। এজন্য সেখানে দুটি সিঁড়ি, দুটি এস্কেলেটর ও শারিরীক প্রতিবন্ধীদের জন্য দুটি লিফট বসানো হয়েছে। নির্মাণাধীন সব স্টেশনেই থাকছে প্রায় এমন ব্যবস্থা।

এরপর তিন তলায় অবস্থিত ১৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের প্ল্যাটফর্ম। এখন সেখানে নির্ধারিত মাপে বসানো হচ্ছে ট্রেনে ওঠার গেট। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত এসব গেইট ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে থামার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে। এরপর যাত্রী ট্রেনে উঠার সুযোগ পাবেন। যে কোনো সময় যাত্রী প্রয়োজন হলে টিকেট ফেরত দিয়ে অর্থ ফেরতও নিতে পারবেন।

কনকোর্স ও প্ল্যাটফর্ম ঘুরে দেখা গেছে, স্টেশনে নির্মাণ কাজে ব্যস্ত সবাই। আগামী এক মাসের মধ্যে স্টেশনের অবকাঠামো নির্মাণের সব কাজ প্রায় শেষ হয়ে যাবে বলে জানান মাহমুদুল হাসান নামের এক কর্মী।

প্রকল্পের উপ ব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, সব স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের আকার একই হবে। আর বড় স্টেশনের কনকোর্সে চেইন শপের ব্যবস্থা থাকবে। সব স্টেশনে যাত্রীদের বসার আসন না থাকলেও উত্তরা উত্তরসহ কয়েকটি স্টেশনে সীমিত সংখ্যক আসন থাকবে।

প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা

দেশের প্রথম মেট্রো রেলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ও শারিরীকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের যাতায়াতের জন্য আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ সুবিধা থাকবে। হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ও খর্বকায় ব্যক্তির জন্য টিওএম মেশিন থেকে সহজে টিকেট সংগ্রহের জন্য অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতার টিকেট বুথ থাকবে। একইভাবে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীরা যাতে টিভিএম মেশিন ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের টিকেট সংগ্রহ করতে পারেন সে ব্যবস্থাও থাকবে।

হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের পেইড জোনে সহজে প্রবেশ এবং বেড়িয়ে আসার জন্য হুইল চেয়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বয়ংক্রিয় ভাড়া পরিশোধের প্রশস্ত গেইট থাকবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের লিফটে সহজে উঠানামার সুবিধার্থে লিফটের ভেতরে ধরার হাতল, নিম্ন উচ্চতায় কন্ট্রোল প্যানেল ও নিজের অবস্থান বোঝার জন্য আয়না থাকবে। কন্ট্রোল প্যানেলে ব্রেইল পদ্ধতির নির্দেশনাও থাকবে।

হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে স্টেশনে উঠানামার জন্য লিফটের সামনে থাকবে র‌্যাম্প।

এমনকি মুক ও বধির যাত্রীরা ডিজিটাল নির্দেশিকা অনুসরন করে স্বাচ্ছন্দ্যে মেট্রো স্টেশনে ও মেট্রো রেলে যাতায়াত করতে পারবেন। অন্ধ যাত্রীদের চলাচলের জন্য ব্লাইন্ড স্টিক ব্যবহারের সুবিধার্থে হলুদ রঙয়ের ট্যাকটাইল পথের ব্যবস্থা রাখা হবে। তাদের জন্য ট্রেনে টয়লেট, লিফট ও অগ্রাধিকার আসন সহজে বোঝার জন্য শনাক্তকারী চিহ্নও থাকবে।

স্টেশন এলাকায় ও ট্রেনের অভ্যন্তরে অডিও ও ভিজুয়াল তথ্যের ব্যবস্থা থাকবে। এ সিস্টেমের মাধ্যমে অন্যান্য যাত্রীর মত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন যাত্রীরাও শোনা ও দেখার মাধ্যমে সহজে মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করতে পারবেন।

ট্রেনের কোচের বর্হিভাগ ও প্লাটফর্মের মধ্যে সর্বত্র এমনভাবে ফাঁকা রাখা হবে যাতে যাত্রীরা নিরাপদে ও সহজে ট্রেনে উঠানামা করতে পারেন।

নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোচ

মেট্রো রেলে নারী যাত্রীদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে প্রতিটি ট্রেনে একটি করে কোচ শুধু নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এতে প্রতি ট্রেনে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩৯০ জন নারী যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। নারীরা চাইলে অন্য কোচেও যাতায়াত করতে পারবেন।

এছাড়া গর্ভবতী নারী ও বয়ষ্কদের জন্য কোচের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত আসন থাকবে।

স্টেশনগুলোতে নারীদের আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা এবং শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ভাড়া

মেট্রো রেলের ভাড়া নির্ধারণে গঠিত কমিটি সম্প্রতি প্রাথমিক প্রস্তাবে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৯০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২০ টাকা ভাড়া নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়া দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন যাতায়াত করা যাবে। এক স্টেশন পর নেমে গেলেও ২০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।

দেশের প্রথম মেট্রো রেলে ঘন্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে ৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। ছয়টি কোচের ট্রেন প্রতিবারে ৩৮ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনে থেমে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।

আরও পড়ুন

দিন বদলের ৩ প্রকল্পের দুয়ার খুলবে ২০২২
 

মেট্রো রেল যাবে কমলাপুর পর্যন্ত, ব্যয় ৮০০০ কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব
 

মেট্রো রেলের শেষ ভায়াডাক্ট বসল, যুক্ত হল উত্তরা থেকে মতিঝিল
 

পরীক্ষামূলক যাত্রায় মেট্রোরেল

মেট্রো রেলের ভেতর-বাহির