ইভিএম নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের আস্থা অর্জন করতে পারলেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১০০ আসনে ইভিএমে ভোট করা সম্ভব হবে।
ইসির ইভিএমকে ‘উন্নত ও আধুনিক’ হিসেবে দেখিয়ে তিনি একইসঙ্গে বলেছেন, এর উপর সবার আস্থা যেন আসে, সেজন্যও নানা পদক্ষেপ রয়েছে তাদের।
বাংলাদেশে যন্ত্রে ভোটগ্রহণের যাত্রাটি শুরু হয় ২০১০ সালে স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। তবে এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন সেই কমিশন সংসদ নির্বাচনে তা নিতে পারেনি।
এরপর কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের ইসি ইভিএম নিয়ে ছিল অনুৎসাহী। কিন্তু কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পরের কমিশন নতুন করে ইভিএম নিয়ে এগোয়। আইন সংশোধন করে তারাই প্রথম ছয়টি সংসদীয় আসনে ইভিএম ব্যবহারও করে।
এ ধারাবাহিকতায় কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশনও এখন ইভিএম ব্যবহার বাড়াতে চাইছে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা ১০০ আসনে ব্যবহারের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে।
কিন্তু তা প্রকাশ হওয়ার পর ইভিএম নিয়ে নতুন করে শুরু হয় আলোচনা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএমের পক্ষ নিলেও বিএনপির কাছ থেকে এসেছে চরম বিরোধিতা।
এরমধ্যেই সোমবার ইভিএম ইসির সার্বিক পরিকল্পনা, পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক মহলে আলোচনা নিয়ে নির্বাচন ভবনে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন নির্বাচন কমিশনার আলমগীর, যিনি আগের কমিশনে ইসি সচিবের দায়িত্বে ছিলেন।
আগামী নির্বাচনে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে আলমগীর বলেন, “(ইভিএম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামতের মধ্যে) আস্থা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে আমাদের ক্যাপাসিটিতে যত ইভিএম আছে, সব ব্যবহার হবে।”
ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্য বলছে, ১১ কোটি ৩২ লাখের বেশি ভোটারের জন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪২ থেকে ৪৫ হাজার ভোটকেন্দ্র করতে হবে। তাতে ভোটকক্ষ হবে আড়াই লাখের বেশি। আর ইসির হাতে ইভিএম আছে দেড় লাখের মতো।
আলমগীর বলেন, “এখন যে ইভিএম রয়েছে, তা নিয়ে কম্পোর্টেবলি ১০০ আসনে নির্বাচন করতে পারব। খুব জোর করে দিতে গেলে ১১০-১২০-১৩০ আসনে হতে পারে। এর চেয়ে বেশি হবে না।”
আগামী নির্বাচনে কত আসনে ইভিএম?
‘ভারতের চেয়ে ভালো’
মো. আলমগীর, তখন তিনি ইসির সচিব।
ভারতে নির্বাচনে ব্যবহৃত ইভিএমের সঙ্গে তুলনা করে আলমগীর বলেন, “আমাদের যে অবজাররেভশন, আমাদের ইভিএম ভারতের ইভিএমের চেয়ে আরও ভালো। অনেক এডভান্সড। এটা টেকনিক্যালি অনেক সাউন্ড। মানের দিক দিয়েও অনেক উন্নত।
“এটার প্রতি অবিশ্বাস রাখার তো কথা না। ভারত যেভাবে অবিশ্বাসটা কাটিয়ে উঠেছে আমরাও সেভাবে কাটানোর ব্যবস্থা করব।”
তার মতে, ভারতে যেহেতু শতভাগ ভোট ইভিএমে হয়, তারা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। সেই অভিজ্ঞতা নেবেন তারা।
“তারা কীভাবে সফল হল, তা স্টাডি করে দেখেছি। তারা আইনানুগভাবে করেছে, আমরাও তা করতে পারি কি না দেখছি। ইভিএমের যে অবিশ্বাসের জায়গাটা রয়েছে, ভারত যেভাবে অবিশ্বাসের জায়গা থেকে বিশ্বাসের জায়গায় এসেছে, সেভাবে আমরাও করে নেব। আমাদের ধারণা, এখানেও বিশ্বাসের জায়গায় চলে আসবে।”
ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সাবেক এই আমলা বলেন, “ইভিএম একটি বিশ্বস্ততার জায়গা; এখানে নির্বাচন হলে ফেয়ার হবে। জালভোট, বাক্স আগে-পরে ভরার সুযোগ নেই, ছিনতাই করে নিলেও লাভ নেই। রেজাল্ট দেওয়া যায় তাড়াড়াড়ি।
“এটা কমফোর্টেবল, একুরেট হয়, গণণায় ভুলত্রুটি-সময়ওক্ষেপণ হয় না, ব্যালট বাক্স নিতে হয় না। সব দিক দিয়ে সুবিধা।”
সবাইকে ভোটে আনতে ইসিকে আস্থার সঙ্কট কাটানোর পরামর্শ
‘আস্থা আনতে’ যে পরিকল্পনা
২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৬ আসনে ভোটগ্রহণ হয়েছিল ইভিএমে। ফাইল ছবি
নতুন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর যে সংলাপ করেছে, তাতে ইভিএম ব্যবহারের আগে এর উপর সবার আস্থা আনার উপর আলোকপাত হয়।
সেই আস্থা আনতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা জানান নির্বাচন কমিশনার আলমগীর।
তিনি বলেন, “দূরে থেকে অবিশ্বাস করেছেন, কাছে এসে দেখেন। ভারতে শুধু দেখেইনি, পলিটিক্যাল পার্টির প্রোগ্রামাররা দেখেছেন, ইঞ্জিনিয়ারদের এনগেজ করেছে পার্টি থেকে। দেখে সার্টিফাই করেছে। “আমাদের এক্সপার্টদের (ইসির আইটি বিশেষজ্ঞ) নিয়ে বসব। সেখানে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদেরও আহ্বান করা হবে। দলগুলোর এক্সপার্ট পাঠাতে বলবো। সব বিশেষজ্ঞ একসঙ্গে বসে এটা দেখবেন, র্যান্ডমলি দেখবেন, যে মেশিনটা দেখতে চান। সবার সামনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। তারপর যে ফাইন্ডিংস আসে; যদি কেউ ত্রুটি বের করতে না পারে, তখন ইভিএম ব্যবহার করব।”
এই বৈঠক আয়োজনে দেরি করবেন না জানিয়ে তিনি বলেন, “একটা দলের পক্ষ থেকে (ব্যবহার না করার) সুপারিশ বলেছেন, সিভিল সোসাইটির অনেকে পক্ষ-বিপক্ষে বলেছেন। যারা বিপক্ষে বলেন তারা থিউরিটিক্যালি সন্দেহ করেন, প্র্যাকটিক্যালি সন্দেহের জায়গা নেই। এ সন্দেহ দূর করার ব্যবস্থা নেব।”
সবার কথা শুনে রাজনৈতিক দলগুলোকে ডাকবে ইসি
‘কোনো অনুরোধ আসেনি’
গত বছর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ। ফাইল ছবি
আওয়ামী লীগের সভায় সব আসনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয় গণমাধ্যমের খবরে এসেছে। তা নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়াও এসেছে।
এ নিয়ে স্বাধীন সংস্থা ইসির কমিশনার আলমগীর বলেন, “গণমাধ্যমে জানলাম-দলীয় সভায় এটা নিয়ে আলোচনা করেছে। আমাদের কাছে এ নিয়ে কোনো ফরমাল, ইনফরমাল কোনো অনুরোধ আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকে আসার তো কোনো সুযোগ নেই। একটা পার্টি দলীয় আলোচনায় এটা করেছে। এটা তাদের মতামত।”
সংবাদ মাধ্যমে অনেক খবর ‘যথাযথভাবে আসে না’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “চ্যানেলে দেখলাম-পত্রিকায় ঠিক যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবে উনারা বলেননি। এক চ্যানেলে দেখলাম-তারা বলেছেন দলীয় সভায় দলের পক্ষ থেকে ইসিকে অনুরোধ করবে প্রস্তাব দেবে, সেটা হবে কি না হবে, সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।
“পত্রিকায় যেভাবে এসেছে, ইলেকট্রনিক চ্যানেলে ঠিক উল্টো এসেছে। এ নিয়ে মন্তব্য নয়। এ ব্যাপারে ইসি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।”
আলমগীর বলেন, কুমিল্লা ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়ে এখন ব্যস্ত তারা। জাতীয় নির্বাচন এখনও অনেক দূর। এ মুহূর্তে এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি।