সুনামগঞ্জ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, পাহাড়ি ঢল, কলবৈশাখীর তাণ্ডব এবং শিলা বৃষ্টিতেও
বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই জেলার ১৩৭টি হাওরের সব ফসল কাটা শেষ করেছেন কৃষকরা। এখন
ধান শুকিয়ে গোলায় তুলতে দিনমান ব্যস্ত কৃষাণ-কৃষাণিরা।
জেলা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, উজানের ঢলে বাঁধ
ভেঙে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ১৯টি হাওরের পাঁচ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমি বাদে এক লাখ ৫৯
হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমিতে দিনরাত কাজ করে ধান কাটা শেষ করেছেন কৃষকরা।
এই
মাসের শেষ সপ্তাহে হাওরের বাইরে আবাদ করা বোরো ধান কাটাও শেষ হবে বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জে
মোট বোরো আবাদ হয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে। তার মধ্যে হাওরে আবাদ
হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে এবং হাওরের বাইরে আবাদ হয়েছে ৫৭ হাজার ৫৭৫
হেক্টর জমিতে। জেলায় হাওরের সংখ্যা ১৩৭টি।

উপপরিচালক
বিমল চন্দ্র সোম জানান, এই এলাকায় পাহাড়ি ঢল শুরু হয় গত ৩১ মার্চে, নদী ফুলেফেঁপে
উঠলে ঝুঁকিতে পড়ে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ। এপ্রিলের ৫ তারিখে টাঙ্গুয়ার হাওরের
নজরখালি বাঁধ ভেঙে তলাতে শুরু করে ফসল। পরে ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্রসোনার থাল,
দিরাই উপজেরার চাপতির হাওরসহ ১৯টি হাওরে পানি ঢুকে পড়ে। কিছু ফসল তলিয়ে যায়,
ক্ষতিগ্রস্ত হন জেলার ২০ হাজার কৃষক।
এই
পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, স্থানীয়
সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ বিশেষ টিম বাঁধে তদারকি শুরু করে। অন্যদিকে ধান
কাটতে গ্রামের মসজিদের মাইকসহ প্রতিটি এলাকায় মাইকে প্রচারণা চালানো হয়।
বিমল
চন্দ্র সোম বলেন, “৮০ শতাংশ পাকা ধান দ্রুত কেটে ঘরে তুলতে সরকার ৬০০ কম্বাইন
হার্ভেস্টর, ১০৮টি রিপার এবং বাইরের জেলা থেকে ২০ হাজার শ্রমিক এনে মাঠে নামানো
হয়। জেলার আরও পৌনে তিন লাখ শ্রমিকও ধান কাটতে নামেন। একদিকে বাঁধ রক্ষার যুদ্ধ
অন্যদিকে ফসল কাটার যুদ্ধে নামেন হাওরের কৃষক। তারা শেষ পর্যন্ত বৈরী প্রকৃতির
সঙ্গে লড়াই করে হাওরের সব ধান কেটে তুলেছেন।”
সরেজমিন বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের দেখার হাওর, শুক্রবার
শনির হাওর, খরচার হাওর ও আঙ্গারুলি হাওর ঘুরে দেখা গেছে, হাওরগুলোর ধান কাটা শেষ।
হাওরের উঁচু এলাকার জমিতে (কান্দা) ধান এখনও মাঠে রয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, এই ধান হাওরের বাইরের আবাদকৃত অংশের
ধান, যা বন্যার ঝুঁকিমুক্ত।
সরকারি হিসাবে, সুনামগঞ্জ সদর, শান্তিগঞ্জ, দোয়ারাবাজার ও
ছাতক উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত দেখার হাওরে এবার প্রায় নয় হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমিতে বোরো
আবাদ হয়েছিল। এই হাওরে এবার বন্যায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

দেখার হাওরের বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল করিম বলেন,
“আমি হাওরে এক হাল জমি চাষ করেছিলাম। বৃহস্পতিবারই আমার ধান কাটা শেষ হয়ে
গেছে। কেবল আমি নই আমাদের এই হাওরের প্রায় সব কৃষকই ধান কেটে তুলেছেন। বন্যা
আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।”
তবে বি-আর ২৮ ও বি-আর ২৯ ধান আবাদ করে কাঙ্ক্ষিত ফসল
আসেনি বলে জানান এই কৃষক। যেখানে কেদার (৩০ শতাংশ) প্রতি ২০ মণ ধান হওয়ার কথা ছিল
সেখানে অর্ধেকও হয়নি বলে আক্ষেপ তার।
সরকারি হিসাবে, খরচার হাওরটি বিস্তৃত সুনামগঞ্জ সদর ও
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নিয়ে, এ হাওরে বোরো আবাদ হয়েছে চার হাজার ৫৯০ হেক্টর জমিতে।
ধান কেটে গোলায় তুলেও ফেলেছেন খরচার হাওরের বিশ্বম্ভরপুর
গ্রামের কৃষক মো. আব্দুর রব।
তিনি বলেন, “আমাদের খরচার হাওরের ধান কাটা শেষ। আমি
১০ কেদার জমিতে ধান রোপণ করেছিলাম। সব ধান কাটা শেষ করেছি। এখন শুকিয়ে গোলাজাত
করছি। এবার ভয় ছিল পানিতে ধান তলিয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি।
স্বস্তিতে ধান কাটা শেষ করেছি।”
ঢলের পানি থেকে ধান রক্ষা হলেও ধানে চিট রোগ ও শিলা
বৃষ্টিতে কৃষকের ক্ষতি হয়েছে বলে জানান আব্দুর রব। তাই বি-আর ২৮ এবং বি আর-২৯ ধানে
তাদের অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদনে কৃষি
পরামর্শ চেয়েছেন এই কৃষক।

একই উপজেলার আঙ্গারুলি হাওরের কৃষক সিরাজপুর গ্রামের
জয়নাল মিয়া বলেন, “হাওরে ধান কাটা শেষ করেছি সত্য। কিন্তু আমাদের আঙ্গারুলি
হাওরের কৃষকরা এবার তেমন লাভবান হতে পারেননি। কারণ বি-আর ২৮ ও বি-আর ২৯ ধান আমাদের
অনেক ক্ষতি করেছে।”
ধানের ব্লাস্ট বা চিটা রোগে কৃষকের সর্বনাশ হয়েছে জানিয়ে
জয়নাল মিয়া বলেন, তাদের আবাদ খরচই ওঠেনি।
তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নিয়ে শনির হাওর।
তাহিরপুরে ছয় হাজার হেক্টর এবং বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে
বোরো লাগানো হয়। হাওরটির কয়েকটি ফসল রক্ষা বাঁধ ছিল চরম ঝুঁকিতে। পাহাড়ি ঢলের পানি
আসা শুরু করলে প্রশাসন ও স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে বাঁধের কাজ করে বলে জানায় কৃষি
বিভাগ।
শেষ পর্যন্ত এই হাওরের শতভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। এখন ক্ষেত
ন্যাড়া। হাওরের নিচের অংশের পানিতে মাছ ধরছেন অনেকে, উপরের অংশে ডাঙ্গায় চড়ছে
গবাদিপশু।
এই হাওরের চাষি আনোয়ারপুর গ্রামের প্রান্তিক আবলুছ বিবি
বলেন, “তিন কেদার (প্রতি কেদারে ৩০ শতাংশ) জমি করেছিলাম হাওরে। এক কেদারে বি-আর
২৮ লাগিয়েছিলাম। মাত্র তিন মণ ধান পাইছি। উৎপাদন খরচও ওঠেনি। বাকি জমিতে বি-আর ২৯
ধান চাষ করেছিলাম। সেই দুই কেদারে ৩০ মণের মতো ধান পেয়েছি।”
কৃষকের অনেক ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে এই চাষি বলেন, সিদ্ধান্ত
নিয়েছি আগামীতে এই ধান আর করব না।
আনোয়ারপুর গ্রামের কৃষক সফর আলী বলেন, “শনির হাওরে
আমি নয় কেদার জমি চাষ করেছিলাম। সব জমির ধান কাটা শেষ করেছি শুক্রবার। এখন কাটা
ধান রোদে শুকিয়ে ভাড়াতে (গোলায়) তোলার কাজ করছি। একই সঙ্গে গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে
ক্ষেতের খড়ও সংগ্রহ করছি।”

শত শত মানুষ রাতদিন বাঁধে কাজ করেছেন জানিয়ে সফর আলী আরও
বলেন, “আমরা প্রশাসনের ঘোষণা শুনে এবং এই অবস্থা দেখে দ্রুত ধান কাটা শেষ
করেছি।”
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বাঁধ ভেঙে ১৯টি হাওরের পাঁচ
হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমির কাচা ধান একেবারে নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ হাজার কৃষকের
তালিকা চূড়ান্ত করে প্রণোদনার জন্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়েছে।
এর আগে হাওর পরিদর্শনে এসে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর
রাজ্জাক, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ও উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহযোগিতা ও প্রণোদনার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এখনও কৃষক কোনো
ক্ষতিপূরণ পাননি।
এদিকে স্থানীয় কৃষক সংগঠন ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ গত ২৬
এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, “৩১টি হাওরের প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির
ধান নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষির সংখ্যাও অনেক বেশি।”

সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, “আমাদের
হিসেবে ৩১টি হাওরের প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির ধান ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু
কৃষি বিভাগ ক্ষতির পরিমাণ কম দেখিয়েছে। ক্ষয়-ক্ষতি কম দেখানোয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা
বঞ্চিত হবেন।
ধানে চিটার কারণে বিভিন্ন হাওরে শ্রমিকরা ধান কাটেননি।
কৃষকরা ধানের মায়ায় সেই সব ক্ষেতের ধান কষ্ট করে কেটেছেন।”
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী-২
শামসুদ্দোহা জানান, গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ফসল রক্ষায় তাদের টিম
অক্লান্ত কাজ করছে হাওরে।
“এবার গত ৩১ মার্চ থেকে পাহাড়ি ঢলের চাপ হাওরের
বাঁধগুলোকে সহ্য করতে হয়েছে। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি ও আসামে প্রায় দুই হাজার
মিলিমিটারের অধিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে ভাটির জনপদের নদনদী পানিতে টইটম্বুর হয়ে
যায়।”
তিনি জানান, যাদুকাটা, বৌলাই, পাটলাই, কংস, সুরমা, পুরান
সুরমা, মহাসিং, চলতি নদীসহ সুনামগঞ্জে সব নদীতে অনেক পানি বৃদ্ধি পেয়েছিল। পানি
থমকেও ছিল বহুদিন। খুব ধীরে কমেছে। যে কারণে প্রতিটি ফসল রক্ষা বাঁধ ঝুঁকিতে ছিল।

তিনি আরও বলেন, “আমরা রাতদিন কৃষকদের নিয়ে বাঁধে
অবস্থান করেছি। আমাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এখন ধান কাটা শেষ হলেও আমাদের বাঁধ
রক্ষার তদারকির কাজ শেষ হয়নি।”
চলতি মৌসুমে (২০২১-২০২২) পানি উন্নয়ন বোর্ড জেলার ছোটবড়ো
৫২টি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৭টি প্রকল্প গ্রহণ
করেছিল। প্রকল্প কমিটি ৫৩৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করেছিল। এসব বাঁধ প্রায় এক মাস
বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন
বলেন, জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে গত এক মাস তারা বিভিন্ন বাঁধ এলাকাতেই ছিলেন, সঙ্গে
ছিলেন কৃষকরাও।
“আমরা বৈরি আবহাওয়ার দিকে চোখ রেখে প্রতিনিয়ত
কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দিয়েছি। বাঁধ রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গে ধান কাটার
কাজও দ্রুত গতিতে চলেছে। ফলে আমরা হাওরের সব ধান কাটা শেষ করতে পেরেছি।”