ব্যাপক দুর্নীতি আর
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে দুনিয়াজোড়া কুখ্যাতি
অর্জন করা
মার্কোস পরিবার
আবারও দক্ষিণ
পূর্ব এশিয়ার
এই দেশের
শাসন ক্ষমতায়
ফিরতে পারবে,
এটা এক
সময় ছিল
অকল্পনীয়।
ফিলিপিন্সের ইংরেজি দৈনিক
ফিলস্টার লিখেছে,
‘মার্কোস পরিবার
আর কখনও
নয়’ স্লোগান
এখনও আছে,
তবে সোমবারের
নির্বাচনে ‘জনতার ঐক্যের’ এক বিভ্রান্তির
জোয়ারে তা
ভেসে গেছে।
চূড়ান্ত ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা
এখনও বাকি
থাকলেও ফিলিপিন্সের
নির্বাচন কমিশনের
প্রকাশ করা
প্রাথমিক ফলাফলে
দেখা যাচ্ছে,
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাবেক সেনেটর বংবং
মার্কোস তার
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর
চেয়ে ১
কোটি ৬০
লাখ ভোটের
ব্যবধানে এগিয়ে
থেকে নিশ্চিত
জয়ের পথে
রয়েছেন।
৬১ শতাংশ ভোট
গণনায় বংবংয়ের
৩ কোটি
৬ লাখ
ভোটের বিপরীতে
বর্তমান ভাইস
প্রেসিডেন্ট লেনি রোব্রেদো পেয়েছেন ১
কোটি ৪৬
লাখ ভোট।
২০১৬ সালে ভাইস
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই লেনি রোব্রেদোর
কাছেই হেরেছিলেন
মার্কোস জুনিয়র। তবে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের
আগে সব
জনমত জরিপেই
এগিয়ে ছিলেন
৬৪ বছর
বয়সী বংবং
মার্কোস।
ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র ওরফে বংবং হতে চলেছেন ফিলিপিন্সের সপ্তদশ প্রেসিডেন্ট। ছবি: রয়টার্স
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি
ফিলিপিন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে এবং
সেনেট, কংগ্রেস,
বিভিন্ন নগরীর
মেয়র ও
কাউন্সিলরসহ প্রায় ১৮ হাজার পদে
ভোট হয়েছে
সোমবার।
দেশটিতে ভোটার
সংখ্যা প্রায়
সাড়ে ছয়
কোটি।
ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের
নির্বাচনে এগিয়ে আছেন বংবংয়ের রানিং
মেট, দাভাও
শহরের সাবেক
মেয়র সারা
দুতার্তে, যিনি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো
দুতার্তের মেয়ে।
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী
সেনেটর কিকো
প্যানগিলিনানের চেয়ে দুই কোটিরও বেশি
ভোট পেয়েছেন।
ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র
বংকং ফিলিপিন্সের
সপ্তদশ প্রেসিডেন্ট
হিসেবে রদ্রিগো
দুতার্তের স্থলাভিষিক্ত হবেন, যার ছয়
বছরের শাসনামল
চিহ্নিত হয়ে
থাকবে মাদকের
বিরুদ্ধে যুদ্ধের
নামে বিনা
বিচারে হত্যার
রক্তাক্ত অধ্যায়
হিসেবে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ,
দুতার্তের সময়ে বিচার বহির্ভূত হত্যার
ঘটনায় ঢালাও
দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি ফিলিপিন্সে চালু
হয়েছে, তার
জের টানতে
হতে পারে
বহু দিন।
সেই সঙ্গে বংবংয়ের
সামনে থাকবে
বিপুল ঘাটতি
আর ঋণে
জর্জরিত অর্থনীতিকে
সামাল দেওয়ার
চ্যালেঞ্জ।
বলা হচ্ছে,
গত শতকের
আশির দশকে
তার বাবা
ফিলিপিন্সকে যে গাড্ডায় নিয়ে গিয়েছিলেন,
তারপর এখনই
সবচেয়ে বাজে
সময় যাচ্ছে
দেশের অর্থনীতির।
১৯৮৬ সালে প্রবল
গণ অভ্যুত্থানে
ক্ষমতাচ্যুত হন বংবংয়ের বাবা ফিলিপিন্সের
সাবেক একনায়ক
ফের্দিনান্দ মার্কোস।
এরপর বিশ্বব্যাপী
মার্কোস পরিবার
যেন দুর্নীতির
সমার্থক হয়ে
ওঠে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং আদালতে দাখিল
হওয়া নথিতে
মার্কোসদের ব্যাপক বিলাসিতা এবং মানবাধিকার
লঙ্ঘনের ঘটনার
অকাট্য সব
প্রমাণ উঠে
আসতে থাকে।
সেসময় বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট
প্রাসাদে ঢুকে
মার্কাস পরিবারের
সদস্যদের চমৎকার সব তৈলচিত্র,
সোনায় মোড়া
বাথটাব, ১৫টি
মিঙ্ক কোট,
৫০৮টি ডিজাইনার
গাউন এবং
মার্কোসের স্ত্রী, ফার্স্ট লেডি
ইমেলদা মার্কোসের
৩ হাজার
জোড়া জুতার
বিশাল সংগ্রহ
দেখতে পান।
মার্কোস পরিবার কীভাবে
লাখ লাখ
ডলার অবৈধভাবে
সুইস ব্যাংকে
স্থানান্তর করেছে এবং নিউ ইয়র্ক
সিটির ম্যানহাটনে
অসংখ্য সম্পত্তি
কিনেছে, তার
তথ্য পরে
বিভিন্ন নথিতে
বেরিয়ে আসে।
১৯৮৬ সালের একটি
ভিডিওতে দেখা
যায়, অভ্যুত্থানের
সময় যখন
মার্কোস পরিবার
যখন প্রেসিডেন্ট
প্রাসাদ ছেড়ে
যেতে বাধ্য
হল, ২৮
বছর বয়সী
বংবং সেদিন
বাবার পাশে
দাঁড়িয়ে ছিলেন
একনিষ্ঠ ছেলের
মতই।
অবশ্য ১৯৭২ সালে
তার বাবা
একটি ডায়েরিতে
ছেলেকে নিয়ে
উদ্বেগ প্রকাশ
করে লিখেছিলেন,
“বংবংকে নিয়েই
আমাদের দুঃশ্চিন্তা
সবচেয়ে বেশি। সে একেবারেই উদাসীন, আর
অলস।”
ইমেলদা মার্কোসের সেই জুতো সম্ভার
১৯৭৫ সালে বংবং
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাজনীতি ও
অর্থনীতি (পিপিই) কোর্সে পড়তে যান। ব্রিটেনে বলা হয়, এই
কোর্স হল
রাজনীতিবিদ হিসাবে ক্যারিয়ার গড়ার প্রবেশদ্বার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি
স্নাতক পাস
করতে পারেননি,
যদিও বিষয়টি
তিনি স্বীকার
করেন না।
ফিলিপিন্সের সংবাদ পোর্টাল
ভেরাফাইলসের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিবিসি
লিখেছে, দুইবার
পরীক্ষায় ফেল
করার পর
ফিলিপিন্সের কূটনীতিকরা সামাজিক বিজ্ঞানে একটি
বিশেষ ডিপ্লোমা
দেওয়ার জন্য
বংবংয়ের পক্ষে
লবিং করেছিলেন
সে সময়।
অবশ্য ডিগ্রি নিয়ে
ওই বিতর্ক
বংবংয়ের রাজনৈতিক
ক্যারিয়ারকে থামাতে পারেনি। অভ্যুত্থানের ধকল সামলে ফিরে
আসার পর
তিনিই এখন
দেশের প্রেসিডেন্ট
হতে চলেছেন।
রদ্রিগো দুতার্তের মেয়ে
সারা দুতার্তেকে
রানিং মেট
হিসাবে পাওয়াও
বংবংয়ের জন্য
আশীর্বাদ হয়েছে। দুতার্তের বিপুল সমর্থনকে কাজে
লাগাতে পেরেছেন
বংবং।
নিজের জনপ্রিয়তার
বাইরেও নতুন
ভোটার পাওয়ার
পথ খুলেছে
তার।
বিবিসি লিখেছে, নির্বাচনের
আগে থেকেই
বংবং ও
তার রানিং
মেট সারা
দুতার্তে ফিলিপিন্সকে
‘একত্রিত’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটের
মাঠে নামেন। তবে কীভাবে সেটা তারা
করবেন, নির্বাচনী
জনসভাগুলোতে সে বিষয়ে খুব কমই
কথা বলেছেন।
ভোটের সময় কিছু
অনিয়মেরও অভিযোগ
এসেছে।
ম্যানিলার একটি স্কুলের কিছু ভোটার
বিবিসিকে বলেছেন,
তাদের ব্যালটপেপার
ভোট গণনা
মেশিনে ফেলতে
সমস্যা হয়েছে। অন্যরা জানিয়েছেন, ভোট না
দিয়ে তাদের
কেন্দ্র ছেড়ে
যেতে বলা
হয়।
এ বিষয়ে নির্বাচন
কমিশনার জর্জ
গার্সিয়ার ভাষ্য, “সব সময় অনিয়মের
অভিযোগ থাকবে,
তবে এখন
পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য
কোনো কিছু
ঘটেনি।
সহিংসতার ঘটনা
খুব কম। সবকিছু পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।”
সমর্থকদের সামনে ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র ওরফে বংবং
বংবংয়ের প্রচার কৌশল
ফিলস্টার লিখেছে, নির্বাচনী
প্রচারের পুরো
মওসুমে বংবং
টেলিভিশনে উপস্থিতি, বিতর্ক, ফোরাম ও
সাক্ষাৎকার
এড়িয়ে চলেছেন। খুব কমই তিনি মিডিয়ার
সামনে হাজির
হয়েছেন।
এর বদলে
তিনি পার্টিজান
ভ্লগারদের মাধ্যমে নিজের বিবৃতির প্রচার
করেছেন।
পাশাপাশি ভোটের মৌসুমের
পুরোটা সময়
সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমগুলোতে ভুয়া প্রচার আর বিভ্রান্তিকর
তথ্যের বন্যা
দেখা গেছে,
যা বংবংয়ের
প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে দুর্নাম
রটিয়েছে এবং
বংবংকে প্রশংসায়
ভাসিয়েছে।
ফিলিপিন্সের পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটির
রাজনীতির অধ্যাপক
রিচার্ড হেইডারিয়ানের
ভাষায় বংবংয়ের
অনুসারীরা এ নির্বাচনকে ‘অপতথ্যের ভাগাড়ে’
পরিণত করেছেন।
মার্কোস পরিবারের কালো
ইতিহাস মুছে
ফেলতেও ধারাবাহিক
প্রচার চালানো
হয়েছে ভোটের
আগে।
বিশ্ব যাকে
স্বৈরশাসক হিসেবে জানে, সেই সিনিয়র
মার্কোসের সময়কে এসব প্রচারে বর্ণনা
করা হয়েছে
ফিলিপিন্সের ‘সুবর্ণ সময়’ হিসাবে।
প্রশ্নের মুখোমুখি
হতে হবে-
এমন বিতর্ক
বা ফোরাম
থেকে দূরে
থেকেছেন বংবং।
একইসঙ্গে অনলাইনে বংবংয়ের
প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ্য করে
অপপ্রচার চালানোর
অভিযোগ এসেছে। তবে বংবং শিবিরের দাবি,
ভুল তথ্য
ছড়ানোর কাজে
তারা জড়িত
নয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ের আভাসে ফের্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের সমর্থকদের উল্লাস। ছবি: রয়টার্স
রয়টার্স লিখেছে, ৬৪
বছর বয়সী
বংবং কোন
নীতিতে দেশ
চালাবেন, তার
কোনো স্পষ্ট
ধারণা নির্বাচনী
প্রচারের সময়
তুলে ধরেননি। ঐক্যের যে প্রতিশ্রুতি তিনি
দিয়ে এসেছেন,
তাও অস্পষ্ট।
বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রেসিডেন্ট
হিসাবে দায়িত্ব
নিয়ে মার্কোস
বংবং বিদায়ী
প্রেসিডেন্ট দুতার্তের শাসনের ধারাবাহিকতাই রক্ষা
করবেন।
দুতের্তের মত তিনিও
বিলিয়ন ডলারের
অবকাঠামো উন্নয়ন
প্রকল্পে বেশি
মনোযোগ দেবেন
এবং চীনের
সঙ্গে আরও
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
গড়ার চেষ্টা
করবেন।
আর বংবংয়ের হাতে
ফিলিপিন্সে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির সমস্যা
আরও খারাপ
চেহারা নেবে
বলেই তার
বিরোধীদের আশঙ্কা।