বিশ্বায়ন ও মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থায় ভর করে মহামারীর আগ পর্যন্ত সময়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির মধ্যে যে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকেন্দ্রিক যে ভারসাম্য দেখা যাচ্ছিল, তা এখন অনেকটা ঝুঁকির মুখে।
নতুন এই বাস্তবতা বাণিজ্য বিশ্বকে কোন পথে নিয়ে যাবে, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে। আর তাতে সম্ভাব্য যে ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে, তা সুখকর নয় মোটেও।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, গত তিন দশকে আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ বাড়ার সুবিধা পেয়ে আসছিল বহুজাতিক কোম্পানি এবং তাদের ভোক্তা গোষ্ঠী। মুক্ত বাণিজ্যের যুগে ইলেকট্রনিক্স, পোশাক, খেলনা ও অন্যান্য পণ্যের ব্যাপক উৎপাদন ও সুলভ প্রবাহ এসব পণ্যের দাম কমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু মহামারীর দুই বছরের ধাক্কা আর তারপর যুদ্ধের অস্থিরতা বাণিজ্য লক্ষ্মীর সেই আপাত সুস্থির বসতকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। আর তাতেই পণ্য প্রাচুর্য আর সস্তার বাজার যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ বলছে, পণ্য কোথায় উৎপাদন করা হবে এবং মজুদ করে রাখতে হবে কিনা- তা নিয়েও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে। এমনকী তাতে যদি পণ্য উৎপাদনের দক্ষতা কমে এবং খরচ বাড়ে, তাতেও হয়ত তারা ছাড় দেবে।
আর এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে মূল্যস্ফীতি ও বিশ্বের সার্বিক অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব হবে গুরুতর।
পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক বিঘ্ন এবং ভূরাজনৈতিক সংঘাতের ফলে বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যবস্থার চাকা উল্টো পথে ঘুরতে শুরু করবে কিনা- তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে।
তবে যে কোম্পানিগুলো এতদিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর সীমানার বাইরে পণ্য উৎপাদন করে আসছিল, সঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে তারা হয়ত রাজনৈতিক ঝুঁকি কমাতে আবার যুক্তরাষ্ট্রে বা উৎসভূমিতে ফিরতে শুরু করবে।
আর যদি সত্যি সত্যি সেটা ঘটে, সেসব কোম্পানির তৈরি করা অনেক পণ্য আর এখনকার মত সাশ্রয়ী দামে মিলবে না। কারণ তুলনামূলক সস্তা শ্রমের, স্বল্প করের দেশে পণ্য উৎপাদন করে, কিংবা দেশে দেশে কারখানা খুলে সরবরাহের খরচ বাঁচিয়ে বছরের পর বছর ধরে কমিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, গাড়ির মত অনেক পণ্যের দাম। সেই ধারায় ছেদ পড়লে দাম বেড়ে যাবে, তাতে বেড়ে যাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি।
পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ওই জটিল অন্তর্জালের সুবিধা নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৫ সাল থেকে গাড়ি ও যন্ত্রপাতির মত দীর্ঘস্থায়ী পণ্যের মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে রাখা সম্ভব হয়েছিল। পোশাক ও অন্যান্য স্বল্পমেয়াদী পণ্যের দামও বেড়েছে খুব ধীরে।
তবে মহামারীর কারণে ২০২০ সালের শেষ দিকে এই ধারা বদলাতে শুরু করে। পণ্য সরবরাহের খরচ বাড়ার পাশাপাশি ঘাটতিও দেখা দেয়; বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গাড়ি, আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতির দাম বাড়তে থাকে।
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ তখনই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, হঠাৎ দাম বেড়ে যাওয়ার এই ধারা হয়ত অব্যাহত থাকতে পারে বেশ কিছু দিন। আবার স্বল্প-দামের পণ্যের ক্ষেত্রে ওই প্রবণতা স্থায়ী হবে না বলেই অনেকে ধারণা করছিলেন।
এরপর এল যুদ্ধ, সঙ্গে অনেক নিষেধাজ্ঞা। অনেক পণ্যের বাণিজ্যপথই তাতে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল।
তাহলে আগামীর ব্যবসা-বাণিজ্য কোন পথে যাবে? নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, বিশ্ব অর্থনীতি বিশ্বায়ন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিনা, তার ওপরেই নির্ভর করবে এ প্রশ্নের উত্তর।
বিশ্বায়ন নিয়ে এ প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জেরোমি পাওয়েল গত মাসে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “আমরা একটি ভিন্ন ধরনের বিশ্বের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, কোনো সন্দেহ নেই। হয়ত সেখানে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি থাকবে, কমে যাবে উৎপাদনশীলতা, কিন্তু অর্থনীতি আরও সহনশীল হয়ে উঠতে পারে, সরবরাহ শৃঙ্খল আরও বিস্তৃত হতে পারে।”
তবে পরিস্থিতির কত দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে, তার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব না বলেন মনে করেন পাওয়েল।
তিনি বলেন, “বিশ্বায়নের চাকা উল্টো পথে ঘুরতে শুরু করেছে এমন কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত এখনও দেখতে পাচ্ছি না। তবে এটা স্পষ্ট যে এর গতি ধীর হয়েছে।”
বৈশ্বিক সংযুক্তির যুগ মহামারীর আগ পর্যন্ত বজায় ছিল, আর তাতে আমেরিকাবাসীর অনেক পণ্য সস্তায় কেনার সুযোগ হয়েছিল। ওই ব্যবস্থা কম্পিউটার এবং অন্যান্য প্রযুক্তির কারখানাকে আরও দক্ষ করে তুলেছে। জুতা, রান্নার টেবিল ও ইলেকট্রনিক্সের মত পণ্যের সরবরাহকে করে তুলেছে সবচেয়ে সহজ।
কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা নিয়ে গেছে এমন দেশে, যেখানে শ্রমের মজুরি কম। স্টিল শিপিং কনটেইনার, এবং বিশাল আকারের মালবাহী জাহাজে বোঝাই পণ্য দ্রুত বাংলাদেশ ও চীনের মতো দেশ থেকে মিসিসিপির সিয়াটল ও টুপেলো বন্দরে ভিড়েছে অনেক কম খরচে।
তবে ওই পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের কারখানা শ্রমিকদের ভাগ্যেও পরিবর্তন এনেছিল, তাদের অনেকে বেকার হয়ে পড়েছিলেন। বিশ্বায়নের ওই রাজনৈতিক ধাক্কাই সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ট ট্রাম্পকে ক্ষমতায় আসতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল, কারণ তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে আবার যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ফিরিয়ে আনবেন।
তার বাণিজ্য যুদ্ধ ও শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কিছু কোম্পানিকে চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে উৎসাহিত করেছে, তবে সেগুলো ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর মত কম মজুরির অন্য দেশে জায়গা নিয়েছে।
মহামারীর সময় অতি সুশৃঙ্খল সরবরাহ ব্যবস্থাতেও প্রভাব পড়েছে। কারখানা বন্ধ থাকা ও পরিবহনে দেরির কারণে অনেক পণ্য ও যন্ত্রাংশ প্রাপ্তি কঠিন হয়ে যায় সে সময়। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস, অ্যাপ্ল্যায়েন্স ও গাড়ির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেমিকন্ডাকটর সরবরাহে বিঘ্নের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয় ।
মহামারীর মাত্র দুই বছরে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে গেছে ১০ গুণ। ফলে বিদেশে ওইসব পণ্য উৎপাদনে খরচ কমানোর যে সুবিধা পাওয়া যেত, তা মিলিয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০২০ সালের শেষ দিকে উৎপাদন সীমাবদ্ধতার সঙ্গে চাহিদাও বাড়ায় ওয়াশিং মেশিন, কাউচ, এবং অন্য বড় পণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে। এরপর থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছেই। ইউক্রেইনে রাশিয়ার সেনা অভিযান সরবরাহ শৃঙ্খলকে আরও বিশৃঙ্খল করে তুলেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গ্যাস ও অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়ায় মার্চজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির সূচক ৬ দশমিক ৬ শতাংশের ওপরেই ছিল। ১৯৮২ সালের পর আর কখনও সেখানে এত দ্রুত মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। ইউরোজোন এবং ব্রিটেনের মতো উন্নত অর্থনীতিতেও মূল্যস্ফীতির ধাক্কা লেগেছে বেশ ভালোভাবেই।
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ আশা করছেন, আগামী মাসগুলোতে দীর্ঘস্থায়ী পণ্যের ক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধির প্রবণতা কিছুটা থিতিয়ে আসবে, যা পণ্যের বাজারে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতাকে শান্ত করতে ভূমিকা রাখবে। মার্চের তথ্য বলছে, এরই মধ্যে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ঋণের সুদহার বাড়ানোয় গাড়ি, বাড়ি ও বড় যন্ত্র কেনা কঠিন হয়ে উঠবে। তাতে অতিরিক্ত কেনার প্রবণতাতেও লাগাম পড়বে।
তবে প্রশ্ন হল, নতুন বাস্তবতায় গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে শুরু করবে কিনা, করোনাভাইরাস আসার আগে ছিল এসব পণ্যের দাম যে পর্যায়ে ছিল, আবার সেখানে নামবে কি না।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘কেয়ারনি’র একটি ‘রিশোরিং ইনডেক্স’ বা ‘দেশের সীমায় ফেরার সূচক’ বলছে, ২০২০ ও ২০২১ সালে কম-খরচের দেশগুলো থেকে আরও বেশি পণ্য আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার অনেক কোম্পানি জানিয়েছে, তারা তাদের কারখানা চীন থেকে সরিয়ে অন্য দেশে নিচ্ছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-আইয়েআলা বলেন, কিছু পরিমানে রিশোরিং হচ্ছে – এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। তবে তথ্যউপাত্ত বলছে, বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই নিজেদের মজুদ বাড়ানো এবং কম-মজুরির দেশ খুঁজে নিয়ে ঝুঁকি সামলানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
আর এই প্রক্রিয়া আফ্রিকা ও বিশ্বের অন্য অংশের দরিদ্র দেশগুলোকে আরও বেশি করে বৈশ্বিক ‘ভ্যালু চেইনে’ সংযুক্ত করে তুলবে বলে মনে করেন ওকোনজো-আইয়েআলা।
মিলকেন ইনস্টিটিউট গ্লোবাল কনফারেন্সে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি ক্যাথেরিন টাই এক সাক্ষাৎকারে বলেন, একটি লম্বা সময় ধরে আমেরিকার ভোক্তারা কম দামে আমদানি পণ্য পাওয়ার ‘বিলাসিতা’ উপভোগ করেছেন, কিন্তু এটা ‘খুবই ভঙ্গুর’ একটি ভিত্তির ওপর দাড়িয়ে আছে।
“আমেরিকনরা শুধু ভোক্তা নয়, তারা কর্মী এবং একটি বিশ্ব বাজারে তাদেরও প্রতিযোগিতায় থাকতে হবে, যেখানে বিশ্বায়ন সাধারণ আমেরিকানদের জন্য সুযোগ আসলেই কমিয়ে দিয়েছে।”
মহামারীতে সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্নের কারণে সংকটে পড়া ফোর্ড মোটর নিজেরাই নিজেদের ব্যাটারি উৎপাদন করার পদক্ষেপ নিয়েছে, যার একটি অংশ আমেরিকাতেই উৎপাদন করা হবে।
কার্বন নিঃসরণ কমানোর সত্যিকারের খরচ নিয়েও চাপে রয়েছে কোম্পানিগুলো। বিশেষ করে পণ্যের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পরিবহনে বিপুল কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত হয়। এই নিঃসরণ কমাতে কোম্পানিগুলো এখন হয়ত আরও বেশি ভোক্তাদের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে।
অ্যালায়েন্স ফর আমেরিকান ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সভাপতি স্কট এন পল জানান, আর্থিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকির সঙ্গে কার্বন-ব্যয়ের হিসাব যুক্ত হওয়ায় আরও বেশি সংখ্যক কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি আসতে উৎসাহিত করছে। আর সেই প্রবণতা তিনি বাড়তেই দেখছেন।