এরকম বহু জার গত কয়েক বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারতে। দুই দেশেই বলা হয়েছে, ওই জারে থাকে সাপের বিষ, দাম কোটি কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশে সাপের বিষের কোনো ব্যবহারই নেই বলে বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য।
এখন পর্যন্ত সরাসরি সাপের বিষ ব্যবহার করে দেশে কোনও ওষুধ তৈরি হয় না। অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের কথাও শোনা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধারণা, সাপের বিষ পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
তাহলে প্রশ্ন থাকে, কোথা থেকে আসছে এসব জার? আর যাচ্ছেইবা কোথায়? কিন্তু এর উত্তর বাংলাদেশ বা ভারতের তদন্তকারীদের কাছে নেই।
অবশ্য ধরা পড়া জারে যে সব সময় সাপের বিষই থাকে, তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। আবার সাপের বিষ উদ্ধারের পর যে বাজার মূল্যের কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, তাও `বাস্তবসম্মত নয়’ বলে দাবি গবেষকদের।
গত শুক্রবার চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার ডিটি রোড সংলগ্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি কাঁচর বোতলে বায়ুরোধক অবস্থায় রাখা ‘সাপের বিষ’ জব্দ করার খবর দেয় নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
পুলিশের দাবি, এই সাপের বিষের মূল্য ৫ কোটি টাকা। এ অভিযানে গ্রেপ্তার তিনজন হলেন ইসমাইল ওরফে মগা বৈদ্য, মো. জয়নাল আবেদীন এবং রুপন চাকমা ওরফে শ্যামল।
গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) মো. জহিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই তিনজন ঝাড়ফুঁকের কাজ করে। এজন্য তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের লোকজন আসে। তারাও বিভিন্ন জায়গায় যায়।
“এত দামি সাপের বিষ তাদের কাছে থাকার কথা নয়। একটি চক্র এই বিষ বিক্রির জন্য তাদের দিয়েছিল। এরা সম্ভবত মধ্যস্বত্বভোগী। কারা তাদের সাপের বিষ দিয়েছে, সেই চক্রটি সম্পর্কে কিছু তথ্য পেয়েছি। তাদের সন্ধান পেলে তখন এ বিষয়ে বলা সম্ভব হবে।”
চট্টগ্রামে ধরা পড়া ওই জারগুলো দেখতে দেশের অন্যান্য এলাকায় ধরা পড়া আগেরগুলোর মতই। সেই রেড ড্রাগন, কোবরা স্নেক পয়জন, মেইড ইন ফ্রান্স এবং একটি কোড নম্বর। ওজন ১৩৫০ গ্রাম।
জহিরুল ইসলাম বলেন, “এরকম সাপের বিষ বাংলাদেশে আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ। এগুলো পাচার হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।”
এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ওই সাপের বিষ বিক্রির চেষ্টা করছিল। সেই খবরের সূত্র ধরেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের পেছনের ব্যক্তিদের ধরা গেলে হয়ত এর উৎস ও গন্তব্য জানা যাবে।
রেড ড্রাগন নামের কোনো ফরাসি কোম্পানির ওয়েবসাইট ইন্টারনেটে পাওয়া যায় না। ভিয়েতনামের একটি কোম্পানির ওয়েবসাইট পাওয়া যায়, তবে তারা বিক্রি করে ফলের জুস।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরেও বিভিন্ন সময়ে ওই রেড ড্রাগন আর সাপের বিষে খবর এসেছে। তবে সেসব জারের রহস্য ভারতীয় তদন্তকারীরাও বের করতে পারেননি।
হিন্দুস্থান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জারের সাথে যারা ধরা পড়ে, তারা মূলত ‘কুরিয়ার’, পেছনের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে বরাবর।
চট্টগ্রাম থেকে সম্প্রতি কুমিল্লায় বদলি হওয়া ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হোসাইন মোহাম্মদ ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে সাপের বিষ বিক্রি নিষিদ্ধ। তবে যথাযথ অনুমতি নিয়ে আমদানি করা যায়।
“এখন পর্যন্ত দেশে কোনো ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সরাসরি সাপের বিষ ব্যবহার করে অ্যান্টিভেনম (সাপের বিষের প্রতিষেধক) তৈরি করে না। তারা মূলত অ্যান্টিভেনম আমদানি করে বিক্রি করে থাকে।”
দেশে একমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে সাপের বিষ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরির গবেষণা চলছে।
ওই সেন্টারের কো-ইনভেস্টিগেটর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অ্যান্টিভেনম তৈরি এবং দুয়েকটি জটিল রোগের ওষুধ তৈরিতে সরাসরি সাপের বিষের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার হয়।
“এর বাইরে চীন, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনামসহ কিছু দেশে ট্র্যাডিশনাল উপায়ে ভেষজ ওষুধ তৈরিতে সাপের বিষের ব্যবহার হয়। তবে বাংলাদেশে এরকম ব্যবহারের কথা জানা নেই।”
এক প্রশ্নের জবাবে ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, “বৈজ্ঞানিকভাবে সাপের বিষ মাদক হিসেবে সরাসরি ব্যবহারের সুযোগ নেই। অতি বিরল কিছু মাদকাসক্ত- যেসব সাপের বিষে নিওটক্সিক উপকরণ আছে, এমন সাপের ‘স্নেক বাইট’ জিহ্বায় নিয়ে থাকে। যা রক্তে গেলে আচ্ছন্নতা তৈরি করে।”
ভারতীয় তদন্তকারীদের বরাত দিয়ে হিন্দুস্থান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি চালানের সঙ্গে আটক ব্যক্তিরা তাদের বলেছেন, ওই সাপের বিষ বাংলাদেশ হয়ে ভারতে ঢুকেছে এবং নেপাল ও ভুটান হয়ে যাচ্ছিল চীনে। সেখানে তাদের সনাতনী ওষুধ তৈরিতে এ বিষ ব্যবহার হত।
ওই তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করা সম্ভব না হলেও একটি সম্ভাবনার বিষয় মাথায় রেখেছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, থাইল্যান্ডের কিছু কলার খামারে মাটির পাত্রে সাপ পোষা হয় বিষ সংগ্রহের জন্য। সেই বিষয় বাংলাদেশ, ভারত হয়ে নেপাল-ভুটান দিয়ে বেরিয়ে যায় চীন বা ইউপোরের কোনো গন্তব্যে।
এই ধারণার একটি কারণ হল, উদ্ধার করা জারের সঙ্গে কখনও কখনও তারা থাই ভাষায় লেখা ব্যবহারবিধিও পেয়েছেন। তবে আরও তথ্যের জন্য থাইল্যান্ড বা চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তেমন কোনো ফল তারা পাননি।
২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকার দক্ষিণখান থেকে ৯ কেজি সাপের বিষসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছিল র্যাব। ওই বিষের দাম ৭৫ কোটি টাকা বলে সেসময় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
এর আগে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈর থেকে ‘৯ কোটি’ টাকা মূল্যের সাপের বিষসহ দুইজনকে গ্রেপ্তারের দাবি করেছিল সিআইডি। তখন বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সাপের বিষ পাচারের তথ্য পাওয়ার কথা জানান সিআইডি কর্মকর্তারা।
সাপের বিষের বাজার মূল্যের বিষয়ে গবেষক মো. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, দেশে অভিযানে যে পরিমাণ সাপের বিষ ধরা পড়ার কথা বলা হয়, তা অবিশ্বাস্য। গবেষণাগারে একজন গবেষক ১ গ্রাম বিষে কয়েক মাস পরীক্ষা চালাতে পারেন।
“চীন, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা গেছি। কিন্তু কোনো ইউনিট হিসেবে বা এত উচ্চ মূল্যে সাপের বিষ বিক্রির কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।”
কয়েক বছর আগে এরকম একটি চালান ধরা পড়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, সে সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনীর অনুরোধে তাদের দেওয়া নমুনা পরীক্ষার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে পঠিয়েছিলেন তারা।
“বিভাগের অধ্যাপক মো. আবু রেজা পরীক্ষা শেষে জানান, সেগুলো বিষ নয়। তাই কোনো চালান ধরা পড়লে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া দরকার আসলে এগুলো কী। যেহেতু বাইরে থেকে আনা কোনো সাপের বিষের চাহিদা বাংলাদেশে নেই, তাহলে এর আড়ালে অন্য কিছুও আসতে পারে।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মো. জহিরুল ইসলাম চট্টগ্রামে ধরা পড়া চালানের বিষয়ে বলেন, “আদালতের কাছে এই সাপের বিষ পরীক্ষার জন্য আমরা নির্দেশনা চাইব। তারপর যেখানে পাঠাতে বলা হয়, তা পাঠানো হবে। প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।”
পুরোন খবর
সাপের বিষের প্রতিষেধক দেশেই হচ্ছে তৈরি
হবিগঞ্জে সাপের বিষসহ ২ ‘পাচারকারী’ গ্রেপ্তার
১২ কোটি টাকার গোখরা সাপের বিষ, সীমানা পিলার ও প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৩
সোনারগাঁওয়ে দুই পাউন্ড সাপের বিষ উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৪