তবে খোলা বাজারে ওই দরে ডলার পাওয়া যায় না। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে কাগুজে ডলার কিনতে সোমবার ৯৭ টাকাও গুনতে হয়েছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। আন্তঃব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য এখন সাড়ে ৯ টাকার ওপরে, যা অতীতে আর দেখা যায়নি।
আন্তঃব্যাংক লেনদেনে গত ৯ মে ডলার বিনিময় হয়েছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সায়। পরদিন টাকার মান ২৫ পয়সা কমানোয় বিনিময় হার বেড়ে হয় ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। সোমবার থেকে তা ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইলসাম জানান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অনেক বিষয়ে বাজারের উপর নিভর্শীল হতে হয়, আমদানির চাপ বেশি রপ্তানির চেয়ে… এজন্য ব্যংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী ডলার দিতে পারছে না… তাই ডলারের দর একটু বেড়েছে।”
কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে বিশ্বজুড়ে চাহিদা বাড়ায় পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় খরচ বেড়ে যায়। তাতে ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকে। তাতে বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশের মুদ্রা টাকাও ডলারের বিপরীতে দর হারাতে থাকে।
শুধু আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত বছরের এপ্রিলে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। জুনে তা এক পয়সা বাড়লেও আগস্ট থেকে টাকার মান দ্রুত কমতে থাকে।
এ সঙ্কট আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিগগরই যে ডলারের দর একটা জায়গায় স্থিতিশীল হবে, তা বলা যাচ্ছে না। আমরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। রেমিটেন্স বাড়ানোর সব টুলসই ব্যবহারের সময় হয়েছে। এটি দ্রুত করতে না পারলে প্রভাব আরো বাড়বে।”
কেন বাড়ছে ডলারের দর
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগের চেয়ে আমদানি ব্যয় তিনগুণ বেড়েছে, বিশেষ করে বিভিন্ন প্রকার তেল আমদানিতে। কিন্তু রপ্তানি ও রেমিটেন্স সেভাবে বাড়েনি। সরকারের চাহিদা পূরণে অনেক সময়েই বাড়তি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। এতে আমাদের লোকসানও গুনতে হচ্ছে।”
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুন-মার্চ) ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ৪ হাজার ২৭৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অর্থাৎ, এই নয় মাসে যেখানে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। তার মানে ডলার খরচ বেড়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে রপ্তানি বেড়েছে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর রেমিটেন্স কমেছে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ, ডলার যা হাতে আসছে, তার চেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বেশি।
পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের বিনিময় হার ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দিলেও কয়েকটি ব্যাংকে ইতোমধ্যে ডলারের দর উঠেছে ৯২ থেকে ৯৪ টাকায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সোমবার রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক নগদে ডলার কিনেছে ৯০ টাকায় আর বিক্রি করেছে ৯২ টাকায়। জনতা ব্যাংকও একই দরে ডলার বেচাকেনা করেছে। অথচ গত জানুয়ারিতেও ব্যাংকটি ৮৫ টাকা ৮৫ পয়সা দর ধরেছিল।
বেসরকারি খাতের ট্রাস্ট ব্যাংক সর্বোচ্চ ৯৩ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার বিক্রয় করেছে; আর কিনেছে ৯২ টাকা ৮০ পয়সায়। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ৯২ টাকা ৭৫ পয়সায়। আর ৯১ টাকা ৭০ পয়সায় ডলার কিনে ৯২ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি করছে মিডল্যান্ড ব্যাংক।
বিদেশি ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ঢাকার শাখা নগদ অর্থে ডলার কিনেছে ৯২ টাকায়, আর বিক্রি করেছে ৯৩ টাকায়। এটিই এখন পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ দর।
‘এত দ্রুত কখনও বাড়েনি’
চাহিদা বাড়ায় কাগুজে ডলারের দরও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলার আসে মূলত বিদেশফেরত প্রবাসী কর্মী ও পর্যটকদের কাছ থেকে। সঙ্গে করে নিয়ে আসা ডলার অনেকে বিক্রি করে দেন মানি চেঞ্জারগুলোর কাছে। আবার বিদেশগামীরা প্রয়োজনে ডলার কিনে নেন এসব প্রতিষ্ঠান থেকে।
দীর্ঘ ২১ বছর ধরে মুদ্রা বিনিয়ময় ব্যবসায় জড়িত আছেন গুলশান-১ এর মর্জিনা মানি চেঞ্জারের ব্যবস্থাপক মো. গোলাম ফারুক অপু। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ২১ বছরের অভিজ্ঞতায় এতো দ্রুত ডলারের দর বাড়তে তিনি দেখেননি।
“অতীতে দেখা গেছে, ডলারের দাম একবারে বেড়েছে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ পয়সা। এখন দেখছি ৫০ পয়সা করেও বাড়ছে… তাও আবার দিনের মধ্যে একাধিকবার।
“দর বাড়লেও মানুষ ডলার কেনা কমাচ্ছে না। গত মঙ্গলবার সকালে ডলারের রেট ছিল ৯২ টাকা ২০ পয়সা; দুপুরে আরও ৩০ পয়সা যোগ হল, বিকালে আবার ৩০ পয়সা বেড়ে হল ৯২ টাকা ৮০ পয়সা। আজ সেই ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৭ টাকায়, আমরা কিনছি এর চেয়ে ১০ থেকে ২০ পয়সা কমে।”
এদিকে খোলা বাজারে ডলার হাতবদল হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন দরে। মানি চেঞ্জারগুলো একেক দর নিচ্ছে ক্রেতাদের কাছ থেকে।
পল্টনের ওয়েস্টার্ন মানিচেঞ্জারের বিক্রয় কর্মী মো. আমিন ভূইয়া বলেন, “গত বৃহস্পতিবারে আমরা বিক্রি করছি ৯৩ টাকা ৬০ পয়সায়, কিনছি ৯৩ টাকা ৩০ পয়সায়। আজ বিক্রি করছি ৯৬ টাকা ৫০ পয়সায়। বাজারের ডলারের সরবরাহ আছে, তবে দাম একটু বেশি “
উভয় সঙ্কট
আমদানি ও অন্যান্য প্রয়োজনে ডলার খরচ যত বাড়ছে, তত টান পড়ছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। গত বছর অগাস্টেই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৮.০২ বিলিয়ন ডলার ছিল রিজার্ভে। এরপর কমতে কমতে তা ৪১ বিলিয়নের ঘরে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশের জন্য এ পরিস্থিতিকে ‘উভয় সঙ্কট’ হিসেবে বর্ণনা করে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে হারে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে সেটা বাড়তে দিলে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে। এর পরে যদি মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ে, তাহলে নিম্নবিত্ত অনেক সমস্যায় পরে যাবে।
“অন্যদিকে ডলারের দামকে যদি ধরে রাখতে হয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংককে ডলার বিক্রি করতে হবে। আর যেহেতু আমদানি খরচের তুলনায় রপ্তানি আয় বা রেমিটেন্স বাড়ছে না। তাই ডলার বিক্রি করতে হলে চাপ পড়বে আমাদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে। আর রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে গেলে আমাদের রিজার্ভ বিপদ জনক পর্যায়ে নেমে যাবে।”
বাংলাদেশের আগে রিজার্ভ থেকে ১১-১২ মাসের বৈদেশিক দায় পরিশোধের সক্ষমতা ছিল, এখন তা সাড়ে ছয় মাসের নিচে নেমে এসেছে।
জাহিদ হোসেনের পরামর্শ, বাংলাদেশ ব্যাংককে ডলার বিক্রি করে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সাধারণত ব্যাংকগুলোর চাহিদা বেড়ে গেলে বা সংকট দেখা দিলে ভারসাম্য বজায় রাখতে ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মে পর্যন্ত সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫১০ কোটি ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। অথচ গত অর্থবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ৭৭০ কোটি ডলার তুলে নিয়েছিল।
শ্রীলঙ্কার দিকে ইংগিত করে তিনি বলেন, “ডলার বিক্রি করলে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে যাবে। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কম রিজার্ভ থাকা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।”
পাশের দেশের উদাহরণ তুলে ধরে জাহিদ হোসেন বলেন, ভারতে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে রুপির মান প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশের টাকা এখনও অতটা দর হারায়নি।
এদিকে টাকার অবম্যূল্যায়নের ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম আরো বাড়বে, সেই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি।
চলতি অর্থবছরে সরকার মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখতে চাইলে গত মার্চ শেষে তা ৬ দশমিক ২২ শতাংশে উঠে গেছে। বাস্তবে এই অংক আরও বেশি বলে অর্থনীতিবিদদের কারও কারও ধারণা।
টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বাড়তি মূল্যস্ফীতির যে চাপ তৈরি হচ্ছে, তা কমিয়ে আনতে আমদানি করা পণ্যের ওপর থেকে ট্যারিফ কমিয়ে আনার পরামর্শ দিচ্ছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।
বিডিনিউজ টোয়োন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভারত, ভিয়েতনামসহ অধিকাংশ প্রতিযোগী দেশ নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যান করেছে। এখন টিকে থাকতে হলেও টাকার মান কমাতে হবে।”
জায়েদ বখতও একমত, পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছেছে, তাতে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
“বাস্তবতা তো মানতে হবে। মূল্যস্ফীতির ভয়ে আগের অবস্থানতো ধরে রাখতে পারা যায় না। এখন সরকার যদি মূল্য যতটা বাড়ল সেই অনুপাতে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর কমিয়ে আনে, তাহলে চাপ কিছুটা কমবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের চেষ্টা
ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে কড়াকড়ি বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এলসি (ঋণপত্র) খুলতে নগদ মার্জিন হার বাড়িয়ে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছে গত ১১ মে।
এর আগে গত ১১ এপ্রিল জরুরি ছাড়া অন্য পণ্য আমদানিতে একদফা কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এলসি খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আগে এ হার ব্যাংক তার গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে ঠিক করত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধিতে প্রবাসীদের ‘ডলার ইনভেস্টমেন্ট ও প্রিমিয়ার বন্ডে’ বিনিয়োগ সীমাও তুলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এখন চাইলে যে কোনো অংকের ডলার বিনিয়োগ করা যাবে, আগে যেখানে সীমা নির্ধারিত ছিল।
[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রতিবেদক ফারহান ফেরদৌস]