মঙ্গলবার বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায়ের ওই দিন ঠিক করে দিয়েছে।
যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ১২ এপ্রিল এ মামলাটি রায় ঘোষণা জন্য অপেক্ষমাণ রেখেছিল আদালত।
মামলার তিন আসামি হলেন: আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই, আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল এবং তার ভাই আব্দুল মতিন। তাদের মধ্যে পলাতক; বাকি দুজন গত ছয় বছর ধরে কারাগারে আছেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মৌলভীবাজার এলাকায় অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যার মত যুদ্ধাপরাধের পাঁচ ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে এ মামলায়।
রাষ্ট্রপক্ষে এ মামলার শুনানি করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি।
প্রসিকিউটর মুন্নি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ মামলাটি আজ আদালতের কার্যতালিকায় এলে রায় ঘোষণার জন্য ১৯ মে দিন রেখেছে ট্রাইব্যুনাল।”
আসামিদের মধ্যে মনাইয়ের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এম সারোয়ার হোসেন, হাবুলের পক্ষে ছিলেন আব্দুস সাত্তার পালোয়ান। হাবুলের ভাই পলাতক আব্দুল মতিনের পক্ষেও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে আব্দুস সাত্তার পালোয়ানই শুনানি করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বলছে, আজিজ ও মতিন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে পালিয়ে বড়লেখায় এসে তারা হানাদার বাহিনীর কাছে আত্নসমর্পণ করেন এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। তখন তাদের সাথে যোগ দেন মান্নান।
২০১৬ সালের ১ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আব্দুল আজিজ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আর পলাতক মতিন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করতেন।
আসামি মান্নান ওরফে মনাই ১৯৭১ সালে জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন বলে তদন্ত সংস্থার ভাষ্য।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বড়লেখা থানা শান্তি কমিটির সদস্য হন এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। ২০১৬ সালের ১ মার্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করে।
প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়ানমিন মুন্নি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আসামিরা নিজেদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে দাবি করলেও ট্রাইব্যুনালে এ বিষয়ে তারা যথাযথ প্রমাণ দিতে পারেননি।
“তারা যে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গিয়ে রাকাজার বাহিনীতে যোগ দিয়ে হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধের সাথে জড়িত ছিল তা ১৭ জন সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্য ও দলিলপত্রে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছি।”
মামলা বৃত্তান্ত
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর মনাই, হাবুল ও মতিনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে, যা শেষ হয় দুই বছর পর ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর।
ওই বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
এরপর ১ মার্চ মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানা পুলিশ আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই ও আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুলকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পরের দিন ২ মার্চ তাদেরকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। আব্দুল মতিনকে আর ধরা যায়নি।
যুদ্ধাপরাধ: মৌলভীবাজারের তিন ‘রাজাকারের’ রায় যে কোনো দিন
২০১৬ সালের নভেম্বরে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করে। ২০১৮ সালের ১৫ মে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনাল বিচার শুরুর আদেশ দেয়।
৫ অভিযোগ
প্রথম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৯শে মে আসামিরা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাস এবং শ্রীনিবাস দাসকে অপহরণ করেন। তিনদিন বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতনের পর জুরি বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাসকে হত্যা করে। শ্রীনিবাস দাস কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যান এবং দুদিন পর বাড়ি ফিরে আসেন।
দ্বিতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে, আসামিরা বড়লেখা থানার বিওসি কেছরিগুল গ্রাম থেকে সাফিয়া খাতুন ও আবদুল খালেককে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আসামিরা সাফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে শাহবাজপুর রাজাকার ক্যাম্প ও বড়লেখা সিও অফিসে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়েও সাফিয়া খাতুনকে ধর্ষণ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাফিয়া খাতুনকে সিও অফিসের বাংকার থেকে উদ্ধার করে।
তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মঈন কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে বাড়ির মালামাল লুটপাট করে। রাজাকারেরা মঈনের বাবা বছির উদ্দিন, নেছার আলী, ভাই আইয়ুব আলী ও ভাতিজা হারিছ আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতন করে। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে তারা মুক্তি পান।
চতুর্থ অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার হিনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মস্তকিন কমান্ডারের বাড়িতে হামলা করে। মস্তকিনকে না পেয়ে তার ভাই মতছিন আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে তারা। নির্যাতনের ফলে মতছিন আলীর পা ভেঙে যায়। আসামিরা মস্তকিন ও মতছিন আলীর বাড়ির মালামাল লুট করে তিনটি টিনের ঘর পুড়িয়ে দেয়।
পঞ্চম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭ নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার ডিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে। তাকে সঙ্গে নিয়ে তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হাবিব কমান্ডারকে আটক করার জন্য বাড়িতে হামলা করে তারা। সেখান থেকে আসামিরা মনির আলী ও তার স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে আসামিরা আফিয়া বেগমকে ধর্ষণ করে। হাবিব কমান্ডার ও মনির আলীর বাড়ির মালামালও লুটপাট করা হয়।