একুশের গানের রচয়িতার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সহযোদ্ধা, সতীর্থ ও বিশিষ্টজনরা তাকে তুলনা করছেন ‘এনসাইক্লোপিডিয়ার’
সঙ্গে; স্মরণ করেছেন তার অসামান্য জীবনের কথা।
সাংবাদিক আবেদ খানের ভাষায়, “একজন কিংবদন্তী মানুষ, যাকে আমরা বলতে পারি জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। ইতিহাস যেন ঠোঁটস্থ ছিল, কণ্ঠস্থ ছিল তার। প্রতিটি সময়, সবকিছু চমৎকারভাবে তিনি বর্ণনা করতে পারতেন, বলতে পারতেন।”
গুরুতর অসুস্থ
স্ত্রীকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৭৪
সালে পাড়ি জমান লন্ডনে। তখন থেকে প্রবাস জীবন শুরু হলেও এ কলামিস্টের মন বাংলাদেশেই
পড়ে ছিল।
কবি ও উপন্যাসিক হাসনাত আব্দুল হাই বলেন, “পুরনো ঘটনা দিন-তারিখ দিয়ে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে কীভাবে বলতেন, তা বিস্ময়কর। তিনি চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া ছিলেন রাজনৈতিক, সামাজিক বিষয়ে।”
কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে যে কলম হাতে নিয়েছিলেন
গাফফার চৌধুরী, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সেটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালেও তা অব্যাহত রেখেছিলেন। সারাজীবন সোচ্চার এমন কলম সৈনিক আজকে জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন।
ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে আক্রান্ত গাফ্ফার চৌধুরীকে মাস দুই আগে লন্ডনের নর্থ উইক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৮৮ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার সকালে লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান একুশের অমর গানের এই রচয়িতা।
গাফফার চৌধুরীর প্রয়াণে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ার কথা জানিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা দীর্ঘ জীবনের অবসান হল। দেশের ইতিহাসের সঙ্গে, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে তিনি যেভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন; বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে তিনি যেভাবে জড়িয়ে ছিলেন- এমন ঘনিষ্ঠ লোক আর বাংলা ভাষায় মানুষদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই।”
কবি হিসেবে আজকের অবস্থানের জন্য নির্মলেন্দু গুণ কৃতজ্ঞতা জানালেন আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রতি।
বললেন, “১৯৭০ সালে হুলিয়া কবিতা নিয়ে পূর্বদেশ পত্রিকায় জনপ্রিয় কলামে তরুণ কবি হিসেবে আমার খুব প্রশংসা করেছিলেন। আমাকে তরুণ কবি হিসেবে স্বাগত জানিয়েছিল। তার ওই লেখার কারণে কবি হিসেবে আমার প্রতিষ্ঠা লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তার এ লেখার কারণে পরিচিতি তৈরি হয়েছিল।”
মাস দুয়েক আগেও শয্যাশায়ী গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় কবি গুণের। তখন বেশিক্ষণ কথা বলতে স্বস্তিবোধ করছিলেন না গাফফার চৌধুরী, যার কবিতা থেকে তৈরি হয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’
গানটি।
নির্মলেন্দু গুণ বলেন, “গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে যখন কথা বলেছি (একজন বাসায়ে এসে কথা বলিয়ে দিয়েছে) তখন বলেছিলেন- ‘আমার কথা বলতে কষ্ট হয়। ধীরে ধীরে কথা বলি।’ …কন্যার মৃত্যুর পর উনার শারীরিক অবস্থার আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল।”
কবি বলেন, “মৃত্যু আমাদের জীবনের পরিণতি হিসেবে দেখি। তার পূর্ণতা দেখা আমাদের সৌভাগ্য। শেষ দিকে (গাফফার চৌধুী) লিখতে পারতেন না, মস্তিষ্ক সচল ছিল। এতে সর্বশেষ বিষয়টি নিয়েও লেখালেখি করে গেছেন। পরিমনীকে নিয়ে যখন নাটক চলছিল, তখন তাকে সমর্থন করে কবিতাও লিখেছিলেন।”
৮৫ বছর বয়সী হাসনাত আব্দুল হাই ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরীর সমসাময়িক। বয়সের ব্যবধান মাত্র কয়েক বছরের। তবে গাফফার চৌধুরীকে তিনি দেখতেন ‘অভিভাবকের মত’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হাসনাত আব্দুল হাই বলেন, “গাফফার ভাইয়ের সঙ্গে সাহিত্যের যে সম্পর্ক- সেময়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলাম- লেখালেখি করব। তিনি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। সাহিত্য শাখায় আমার গল্পও ছেপেছেন।
“আমার সাহিত্য চর্চায় তার বেশ পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। এর আগেই তিনি প্রবাদ প্রতীম মানুষ হয়ে গিয়েছেন। তার অবিস্মরণীয় কবিতা, গানের জন্য– ‘আমি কি ভুলিতে পারি’। সেই হিসেবেও তিনি আমাদের সবার কাছে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন।”
কবি, ঔপন্যাসিক হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ভাষায়, গাফফার চৌধুরীর বিশ্লেষণই ছিল তার ‘স্বকীয়তা’। ‘অসাধারণ’ ছিল স্মৃতি শক্তি।
“তিনি একটা চলমান এনসাইক্লোপেডিয়া ছিলেন রাজনৈতিক সামাজিক বিষয়ে। এতো কিছু জানতেন, এত কিছু মনে রাখতেন অবাক করার মতো।”
প্রিয় ‘গাফফার ভাইকে’ নিয়ে স্মৃতিকাতর হাসনাত আব্দুল হাই বলতে বলতে ফিরে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দিনগুলোতে।
“মধুর দোকানে গিয়ে গাফফার ভাইকে নিয়ে আড্ডা দিতাম। অনেক স্মৃতি আমাদের। শেষের দিকে মতাদর্শের কারণে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। … সবার আকর্ষণ ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। সকল বিভাগের ছেলে মেয়েরাই তার প্রতি আকৃষ্ট হত, তার ডাকে সাড়া দিত। তাকে ‘ভাই’ বলত, সবারই গাফফার ভাই ছিলেন তিনি।“
মতাদর্শের ভিন্নতা থাকলেও আবদুল গাফফার চৌধুরীকে একটি ‘প্রতিষ্ঠান’ হিসেবেই দেখেন হাসনাত আব্দুল হাই।
“তিনি ছিলেন সৎ। যাকে পছন্দ করতেন না তার সম্পর্কে বলতেন, চুপ থাকতেন না। যাকে পছন্দ করার করতেন, যাকে অপছন্দ করার করতেন।”
গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে সুদীর্ঘকালের সম্পর্ক ৭৭ বছর বয়সী আবেদ খানের। তার কাছে ‘গাফফার ভাই’ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের একটি ‘প্রাণকেন্দ্র’।
“তিনি আমাদের দেশের ইতিহাসের, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের, দেশের রাজনৈতিক গতিধারার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্তম্ভ।… সেই পাকিস্তানের সময় থেকেই তিনি সোচ্চার ছিলেন। সাংবাদিকতা থেকে, বিশ্বাস থেকে, বিভিন্ন সময়ে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আমরা তাকে পেয়েছি।
“এমনকি আমাদের বিভিন্ন বক্তব্য, যুক্ত বিবৃতিতে সর্বাগ্রে তাকে তুলে ধরতাম। যিনি আমাদের অভিবাবকের মত পাশে থাকতেন। অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে দাঁড়াতেন।”
গাফফার চৌধুরী প্রবাসে থেকেও ‘কাছে ছিলেন’
মন্তব্য করে আবেদ খান বলেন, “উনি দেশে এলেই দেখা হত, বাসায় আসতেন। আমাদের পরিবারের সদস্যদের স্নেহ করতেন, সবার নাম জানতেন, পারিবারিকভাবেও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সবশেষ আমাকে বলেছিলেন- এবার যাচ্ছি, হয়ত আর ফিরতে পারব না। এ কথাটি সত্যি পরিণত করে চলে গেলেন।”
বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেনের কাছে আবদুল গাফফার চৌধুরী হলেন এ দেশের ‘ইতিহাসের মানুষ’, ভাষার আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত যার গান দীর্ঘ সময় ধরে প্রজন্মকে আলোকিত করে যাচ্ছে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, স্বাধীন বাংলার প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা জয়বাংলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক
গাফফার চৌধুরী। লেখক তো ছিলেনই, কিন্তু কলাম লেখক হিসেবে তার বিশিষ্ট পরিচয় ছিল।
“আমাদের কলাম লেখক হিসেবে যদি কোনো কিংবদন্তির কথা বলতে হয়, তাহলে মালেক মিয়া ও আবদুল গাফফার চৌধুরীর নাম প্রথমে আসবে। তিনি আমাদের সময়ের সজীব সাক্ষাৎ প্রতিচ্ছবি।
“আমাদের ভাষা আন্দোলন, বিভিন্ন সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ- সবকিছুতেই আবদুল গাফফার নামক সৃজনশীল সত্তাটি জড়িত। তিনি বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।”
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গঠিত তৎকালীন রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক স্মরণ করেন সেই সময়ের গাফফার চৌধুরীর কথা।
“একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের পথ, জনগণের সংগ্রামের পথ। আমরা সেই পথে বাঙালি এবং বাঙালিত্বের চেতনায় আবদুল গাফফার নিরন্তর লেখালেখি করে গিয়েছেন। শুধু লেখক হিসেবেও তিনি জনপ্রিয় হতে পারতেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের গান তাকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান এক শোকবাণীতে বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন গর্বিত শিক্ষার্থী। তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ও বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরতে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন।
আর বাংলাদেশ কবিতা পরিষদের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, “বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গনঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ও তিনি কলকাতায় জয় বাংলা পত্রিকায় কাজ করেছেন। বিশ্বখ্যাত একজন বরেণ্য সাংবাদিক হিসেবে তার অবদান বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা সাথে স্মরণ করবে।”