ক্যাটাগরি

যুদ্ধাপরাধ: মৌলভীবাজারের ৩ ‘রাজাকারের’ প্রাণদণ্ড

দণ্ডিত তিন যুদ্ধাপরাধী হলেন: আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই, আব্দুল আজিজ ওরফে
হাবুল এবং তার ভাই আব্দুল মতিন। তাদের মধ্যে আব্দুল মতিন পলাতক; বাকি দুজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত
ছিলেন।

বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের
নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বৃহস্পতিবার এ মামলার রায়
ঘোষণা করে। এ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু আহমেদ জমাদার এবং
কে এম হাফিজুল আলম।

সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ২৪০ পৃষ্ঠার এ রায়ের
সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান তিন বিচারক। যুদ্ধাপরাধের পাঁচ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিন
আসামির সবার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এর মধ্যে আজিজ ও মতিনকে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, অন্য
দুটি অভিযোগে তাদের মোট ৩০ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। আর মান্নানকে এক অভিযোগে
মৃত্যুদণ্ড এবং আরেক অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে।

আসামিদের মধ্যে মনাইয়ের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন এম সারোয়ার হোসেন,
হাবুলের পক্ষে ছিলেন আব্দুস সাত্তার পালোয়ান। হাবুলের ভাই পলাতক আব্দুল মতিনের পক্ষেও
রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসেবে আব্দুস সাত্তার পালোয়ানই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে
ছিলেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি।

এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর মুন্নি বলেন, “এই রায়ে আমি একজন
নারী হিসেবে বীরাঙ্গনাদের সম্মান জানাচ্ছি, যারা এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে
ট্রাইব্যুনালে আসতে পেরেছেন এবং যারা আসতে পারেননি, সবার প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। এই
রায়ে আমরা প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তুষ্ট।”

অন্যদিকে আসামি আজিজ ও মতিনের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান এবং মান্নানের
আইনজীবী সারোয়ার হোসেন বলেন, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে সুপ্রিম
কোর্টে আপিল করতে পারবেন কারাগারে থাকা আজিজ ও মান্নান। আর মতিনকে আপিল করতে হরে
আগে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের
প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত
সংস্থা বলছে, আজিজ ও মতিন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে
ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে পালিয়ে বড়লেখায় গিয়ে তারা হানাদার
বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। তখন তাদের সাথে যোগ
দেন মান্নান।

২০১৬ সালের ১ মার্চ গ্রেপ্তার
হওয়ার আগে আব্দুল আজিজ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আর পলাতক মতিন জামায়াতে ইসলামীর
রাজনীতি করতেন।

আসামি মান্নান ওরফে মনাই
১৯৭১ সালে জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন
বলে তদন্ত সংস্থার ভাষ্য।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি
বড়লেখা থানা শান্তি কমিটির সদস্য হন এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। ২০১৬ সালের ১
মার্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করে।

প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়ানমিন
মুন্নি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আসামিরা নিজেদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে
দাবি করলেও ট্রাইব্যুনালে এ বিষয়ে তারা যথাযথ প্রমাণ দিতে পারেননি।

“তারা যে মুক্তিযুদ্ধের
বিরুদ্ধে গিয়ে রাকাজার বাহিনীতে যোগ দিয়ে হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধের
সাথে জড়িত ছিল তা ১৭ জন সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্য ও দলিলপত্রে প্রমাণিত হয়েছে।”

অন্যদিকে আজিজ ও
মতিনের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, “সব নথিপত্রে এবং সহমুক্তিযোদ্ধারা
বিভিন্ন সময়ে বক্তব্যে বলেছেন- এই আসামিরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কিন্তু একজন
ব্যক্তির প্ররোচনায় তদন্ত সংস্থা তাদেরকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।

“আমরা আদালতের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আমরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব, আশা করছি আপিলে তারা
মুক্তিযোদ্ধা মর্মে প্রমাণিত হবে, উচ্চ আদালত থেকে তারা খালাস পাবেন।”

 

যে অভিযোগে যে
সাজা

প্রথম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৯
মে আসামিরা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী
পার্টির (ন্যাপ) নেতা হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাসসহ মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার
দাস এবং শ্রীনিবাস দাসকে অপহরণ করেন। তিন দিন বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে
আটক রেখে নির্যাতনের পর জুরি বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে হরেন্দ্রলাল দাস ওরফে হরিদাসসহ
মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাসকে হত্যা করে। শ্রীনিবাস দাস কোনোক্রমে প্রাণে
বেঁচে যান এবং দুদিন পর বাড়ি ফিরে আসেন।

দণ্ড: এ
অভিযোগে আসামি আব্দুল মান্নান মনাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়
অভিযোগ:
১৯৭১ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে আসামিরা বড়লেখা থানার বিওসি কেছরিগুল
গ্রাম থেকে সাফিয়া খাতুন ও আবদুল খালেককে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার
ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আসামিরা সাফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে
শাহবাজপুর রাজাকার ক্যাম্প ও বড়লেখা সিও অফিসে রাজাকার ক্যাম্পে নিয়েও সাফিয়া
খাতুনকে ধর্ষণ করা হয়। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাফিয়া
খাতুনকে সিও অফিসের বাংকার থেকে উদ্ধার করে।

দণ্ড: এ
অভিযোগে দুই ভাই আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল ও আব্দুল মতিনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৩
নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মঈন কমান্ডারের বাড়িতে
হামলা করে এবং লুটপাট চালায়। রাজাকারা মঈনের বাবা বছির উদ্দিন, নেছার আলী, ভাই
আইয়ুব আলী ও ভাতিজা হারিছ আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক
রেখে নির্যাতন করে। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে তারা মুক্তি পান।

দণ্ড: এ
অভিযোগে আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল এবং আব্দুল মতিনকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৪
নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার হিনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মস্তকিন কমান্ডারের
বাড়িতে হামলা করে। মস্তকিনকে না পেয়ে তার ভাই মতছিন আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও
অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে তারা। নির্যাতনের ফলে মতছিন আলীর পা ভেঙে
যায়। আসামিরা মস্তকিন ও মতছিন আলীর বাড়ির মালামাল লুট করে তিনটি টিনের ঘর পুড়িয়ে
দেয়।

দণ্ড: এ
অভিযোগে তিন আসামির সবাইকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

পঞ্চম অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭
নভেম্বর আসামিরা বড়লেখা থানার ডিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে।
তাকে সঙ্গে নিয়ে তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হাবিব কমান্ডারকে আটক করার জন‌্য বাড়িতে
হামলা করে তারা। সেখান থেকে আসামিরা মনির আলী ও তার স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে
কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে আসামিরা আফিয়া বেগমকে
ধর্ষণ করে। হাবিব কমান্ডার ও মনির আলীর বাড়ির মালামালও লুটপাট করা হয়।

দণ্ড: এই
অভিযোগে দুই ভাই আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল ও আব্দুল মতিনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।

মামলা
বৃত্তান্ত

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর মনাই, হাবুল ও
মতিনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে, যা শেষ হয় দুই বছর পর ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর। ওই
বছর ৩ মার্চ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।

এরপর ওই দিনই মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানা পুলিশ মান্নান ও আজিজকে
গ্রেপ্তার করে। ২ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে তাদের
কারাগারে পাঠানো হয়। আব্দুল মতিনকে আর ধরা যায়নি।

২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তিন আসামির
বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করে। ২০১৮ সালের ১৫ মে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে
ট্রাইব্যুনাল বিচার শুরুর আদেশ দেয়।

এরপর একই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়ে পরের বছর ২০১৯
সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ১৭ জন সাক্ষির সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়।

পরে ২০২১ সালের ১ নভেম্বর থেকে পরের বছরের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত এ মামলার
যুক্তিতর্ক চলে। ওই দিন থেকে রায়ের জন্য অপেক্ষায় ছিল মামলাটি।