অঞ্জলি খারিয়া ভারতের আসামের ডিব্রুগড় জেলার চাপাতোলি গ্রামের এক চা-বাগানে কাজ করেন। সারা দিন কাজের পর বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি।
তাই খাবার শেষে আর অপেক্ষা না করে রাতের ঘুমের জন্য শুয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ, রাত ৩টার দিকে তার ছয় বছরের মেয়ে সুস্মিতার বমির শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়।
তারপর মেয়ের শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব শুরু হয়। পরে কাঁপুনি হতে থাকে। মেয়ের অবস্থা সারা রাত ধরে এমন চলতে থাকলে খারিয়া চিন্তিত হয়ে পড়েন।
কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর তার ছেলে ও শ্বশুরের অবস্থাও খারাপ হতে শুরু করলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে যান। ৩৭ বছর বয়সী খারিয়া বলেন, “তারা সবাই একসঙ্গে বমি করছিল। এরপর তাদের ভয়ানক ডায়রিয়া শুরু হয়।”
পরে খারিয়া বুঝতে পারেন, শুধু তাদের ঘরেই এ সমস্যা নয়, আশপাশের আরও কয়েকজনের সে রাতে একই সমস্যা হয়েছিল। তিনি বলেন, “এটা দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। সবাই যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, কিন্তু কেন তা কেউ জানত না।”
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই খারিয়া তার মেয়েকে নিয়ে কাছের একটি ফার্মেসিতে ছুটে যান। সেখানে তাকে স্যালাইন ও ওষুধ দেওয়া হয়। অন্যদের হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়।
ছেলে এবং শ্বশুরকে বাঁচাতে নিজের জমানো শেষ অর্থটুকুও ব্যয় করেন অঞ্জলি খারিয়া। তিনি বলেন, “ওষুধ সেবনের পর মেয়ের কিছুটা ভালো লাগতে থাকায় তাকে আর তাদের সঙ্গে পাঠাইনি। ভেবেছিলাম শিগগিরই সে ভাল হয়ে যাবে।”
ছবি: বিবিসি
কিন্তু ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে মেয়ে আবার বমি করতে শুরু করে।এবার খারিয়ার কাছে অ্যাম্বুলেন্স ডাকার জন্য আর কোনও টাকা ছিলনা। কয়েক ঘণ্টা পরেই তার কোলে মারা যায় সুস্মিতা।
পরে জানা যায়, সেদিন যারা অসুস্থ হয়েছিলেন, তারা সবাই এক ধরনের বুনো মাশরুম খেয়েছিলেন, যা খারিয়ার শ্বশুরই কাছের জঙ্গল থেকে ছিঁড়ে আনেন। তিনি এই মাশরুম তাদের প্রতিবেশীদেরও দিয়েছিলেন।
সরকারি রেকর্ডে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, ৬ বছরের সুস্মিতা ছাড়াও সেদিন আরও দুজন মারা গিয়েছিলেন। মোট ১১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
এক মাস পেরিয়ে গেলেও গ্রামবাসীরা এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মারা যাওাদের মধ্যে ছিলেন ৩৬ বছরের নেহা লামার স্বজনরাও। তিনি বলেন, “ওই রাতের কথা কোনও দিন ভুলব না, ভেবেছিলাম কেউ বাঁচবে না।”
লামা নিজেও অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। ছেলেকে নিয়ে সারা দিন হাসপাতালে ছিলেন তিনি। লামা বলেন, “আমরা বহু বছর ধরেই মাশরুম তুলে খেয়ে আসছি। আমরা কিভাবে জানব সেগুলো বিষাক্ত হতে পারে?”
ভারতের আসাম ও কাছের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে মাশরুমের বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর বিষয়টি প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয়। তাছাড়া, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে স্থানীয়রা গজিয়ে ওঠা মাশরুম, ফার্ন ও বুনো ফল খায় এবং বিভিন্ন খাবারে সেগুলো ব্যবহার করে।
কিছু এলাকায় বুনো মাশরুমও সুস্বাদু বলে বিবেচিত হয় এবং স্যুপ ও সবজি হিসেবে রান্না করে খাওয়া হয়। আসামে বুনো মাশরুম খেয়ে মৃত্যু সাধারণ ঘটনা, বিশেষ করে মার্চ ও এপ্রিল মাসে।
এ সময়ে রাজ্যর বিখ্যাত সব চা বাগানের সবুজ জমিতে শত শত মাশরুম গজায়। এই মাশরুমগুলো প্রায়ই বিষাক্ত হয় এবং এর শিকার হন হতদরিদ্র শ্রমিকরা। এসব মৃত্যুর খতিয়ান সরকারি হিসাবে থাকে না।
তবে আসামের দুজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বিবিসি-কে জানিয়েছেন, এপ্রিলেও বিষাক্ত মাশরুমে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যাদের বেশির ভাগই চা-বাগানের শ্রমিকদের পরিবারের সদস্য।
এর আগে ২০০৮ সালে বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে ২০ জন মারা গিয়েছিল। যাদের বেশির ভাগই ছিল চা-বাগানের শ্রমিক। বুনো মাশরুম খাওয়ার ঘটনা এখন পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যু।
রাজ্য সরকার সে সময় বিষয়টি তদন্ত করার জন্য একটি প্যানেল গঠন করেছিল বলে জানিয়েছেন, আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এবং তদন্ত প্যানেলের অন্যতম সদস্য দিলিপ কুমার শরমা।
তিনি বলেন, “এর একটি বড় কারণ চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, মাশরুমের ধরনের প্রশ্ন যখন আসে – তারা জানে না কোন ধরনটি বিরল, কোনটি সুস্বাদু আর কোন ধরনটি বিষাক্ত।” শরমা মনে করেন, বাগান মালিকদেরই দায়িত্ব তাদের শ্রমিকদের রক্ষা করা।
তিনি বলেন, “সরকার অতীতে এ ধরনের মাশরুমের ব্যাপারে সচেতনতামূলক বার্তা, সতর্কতা ও পরামর্শ সংবাদপত্রে বেশ কয়েকবার ছাপিয়েছে। কিন্তু তা চা-বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলোর কাছে পৌঁছায় না। কারণ অধিকাংশ শ্রমিকই পড়াশোনা জানেন না।” তবে এই সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলছেন, বিষয়টি এত সহজ নয়।
আসামের উর্বর পাহাড়গুলোতে বিশ্বের সবচেয়ে দামী কিছু চা উৎপাদন হয়। এগুলোর মালিক বড় বড় ভারতীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে আছে বিলাসবহুল মোটেল, যেগুলো পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু এত কিছুর প্রধান কারিগর যারা, সেইসব শ্রমিকের জীবনযাত্রা মান খুব খারাপ।
চাপাতোলী গ্রামে বিবিসি যে কয়েকজন চা-শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা টিনের ছাদ ও বাঁশের কুটিরে বানানো বাড়িতে বাস করে। যেখানে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই খারাপ। মজুরি এতটাই কম যে চা-শ্রমিকরা প্রায়ই অভুক্ত থাকেন। সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারী এবং বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে গিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
অঞ্জলি খারিয়া দিনে ১৩০ রুপি মজুরি পান। তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের ছয় সদস্য। তিনি বলেন, “এসব কারণেও আমরা যা পাই তাই খুঁজে তুলে সেগুলো খাই।”
তিনি আরও বলেন, “আমার মেয়ের মৃত্যুর পর সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের দেখে গেছেন। তারা বিষাক্ত মাশরুম না খেতে বলেছেন। কিন্তু আমরা খুব গরিব। আর সবকিছুর দাম অনেক বেশি। তাই যা পাই তা খেয়েই আমাদের বাঁচতে হয়।”
জেলা প্রশাসন বলছে, তারা সমাজকল্যাণ প্রকল্পের মাধ্যমে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ডিব্রুগড়ের উপ কমিশনার বিশ্বজিত পেগু বলেন, “আমরা সরকারি বিতরণ ব্যবস্থার আওতায় তাদের বিনামূল্যে রেশন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করছি।”
তবে অঞ্জলি খারিয়া এবং অন্যান্যরা এমন কথা অস্বীকার করে বলছেন, তারা কখনও বিনামূল্যে খাদ্যশস্য পাননি। “কোনও কোনও দিন খাওয়ার কিছুই থাকে না। তারপরও কেউ সাহায্য করতে আসে না,” বলেন তারা।
ছবি: বিবিসি
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয়রা হালকা সবুজ কিংবা সাদা রঙের ‘ডেথ ক্যাপ’ নামে পরিচিত এক ধরনের মাশরুম তুলে খেলে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই বিষাক্ত মাশরুম সুস্বাদু বলে অনেকেই মনে করেন।
এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে- শ্বাসকষ্ট, বমি, পেট ব্যাথা এবং মারাত্মক ডায়রিয়া। বহু ক্ষেত্রেই অসুস্থ হওয়ার পরপরই রোগীরা হাসপাতালে যায় না। এতে কিডনি কিংবা লিভার বিকল হয়ে পড়ার মতো মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় বলে জানিয়েছেন আসাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট প্রশান্ত ডিহিঙ্গিয়া।
তিনি বলেন, “যে সময়ে তারা চিকিৎসা নিতে আসে তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।” ডিহিঙ্গিয়া মনে করেন সমস্যা মোকাবেলার একমাত্র উপায় হচ্ছে কোন ধরনের মাশরুম বিষাক্ত হতে পারে তা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো।
“কোনও জনগোষ্ঠীকে তাদের প্রথাগত খাবার খাওয়া বন্ধ করানোসম্ভবনয়, কিন্তু তাদেরকে নিরাপত্তার বিষয়টি শেখানো যেতে পারে,” বলেন তিনি।
ডিব্রুগড়ের উপ কমিশনার বিশ্বজিত পেগু বলেন, গ্রামে গ্রামে যাওয়া এবং সবার সঙ্গে দেখা করে এগুলো বোঝানো সম্ভব নয়। তবে কর্তৃপক্ষ তৃণমূল পর্যায়ে প্রচার চালিয়ে বিষাক্ত এবং খাওয়ার যোগ্য মাশরুম সম্পর্কে আলাদা করা শেখানোর চেষ্টা করছে।
স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়মিতই গ্রামে যাচ্ছে এবং মাশরুমের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান পেগু। তবে চাপাতলী গ্রামের বাসিন্দারা এতে আশ্বস্ত নন। অঞ্জলি খারিয়া বলেন, “আমাদের জন্য আমরাই আছি। আমাদের কেউ মারা গেলেই কেবল তারা (কর্মকর্তারা) আসেন।”