দেশের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ ও জিরার মত মসলার দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে।
এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও। পাড়ার দোকানে এসব মসলার দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত।
দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন, জাহাজীকরণে দেরি, কন্টেইনারের ভাড়া বৃদ্ধি এবং আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার সংরক্ষণের নির্দেশনার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, ‘পর্যাপ্ত’ আমদানি হলেও দেড় মাস পর কোরবানির ঈদে মসলার বাজারে এর প্রভাব পড়বে।
খাতুনগঞ্জে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এলাচের দাম। ব্যবসায়ীরা জানান, পাইকারিতে এলাচের কেজি এখন এক হাজার ৪৬০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে এক হাজার ২৮০ টাকা ছিল। এই হিসাবে সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে কেজিতে ১৮০ টাকা।
পাইকারিতে জিরা বিক্রি হচ্ছে ৩৯৪ টাকা কেজি দরে, যা গত সপ্তাহে ৩৮৫ থেকে ৩৮৭ টাকা ছিল।
আগের সপ্তাহে ৯৫০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হওয়া লবঙ্গ এখন ১ হাজার ৫০ টাকা কেজি। আর মানভেদে ২৮৫ থেকে ৩৬০ টাকায় বিক্রি হওয়া দারুচিনির দামও এক সপ্তাহে কেজিতে আট থেকে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০৫ থেকে ৩৭৭ টাকা হয়েছে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, এসব মসলা মূলত আমদানি হয় ভারত, আফগানিস্তান, গুয়েতামালা, মাদাগাসকার, সিরিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, ইরান ও তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ থেকে।
এরমধ্যে ভারত থেকে মসলা আসে সড়ক পথে। আর অন্যান্য দেশ থেকে আনা হয় জাহাজে করে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাসখানেক আগেও ডলারের দর ৮৬ থেকে ৮৭ টাকা ধরে এলসি খোলা হত, এখন তা খুলতে হচ্ছে ৯৬ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক গুলিস্তান ট্রেডার্সের মালিক আবদুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মসলার বাজার এখন কিছুটা বাড়তি। ডলারের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের বাড়তি দামের কারণে ক্রয়মূল্যও বেশি পড়ছে।”
রোজার ঈদের সময় মসলার বাজার একটু পড়তির দিকে ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “ওই সময় ব্যবসায়ীরা লোকসানে মসলা বিক্রি করেছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি মার্জিনের হার নতুন করে নির্ধারণ করেছে। তাতে ডলারের হিসেবে আগের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে আমাদের এলসি খুলতে হচ্ছে। পণ্য আসার পর বাকি টাকা পরিশোধেও ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছে।”
মসলার দাম সামনে আরও বাড়বে বলে আভাস দেন আমদানিকারক আবদুর রাজ্জাক।
পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার প্রভাবে খুচরা বাজারেও বিভিন্ন মসলার দাম বেড়ে যওয়ার কথা বললেন চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারের দোকানিরা।
তাদের ভাষ্য, মসলা বাজারের দাম নির্ভর করে খাতুনগঞ্জের পাইকারদের ওপর। সেখানে দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবে খুচরায় দাম বেড়ে যায়।
এ বাজারের মসলা বিক্রেতা রণ দাশ বলেন, “বেশ কিছুদিন মসলার দাম স্থিতিশীল ছিল। তবে রোজার ঈদের পর দাম বাড়তির দিকে।”
বৃহস্পতিবার রেয়াজউদ্দিন বাজারে জিরা বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪২০ টাকা দরে। এক সপ্তাহ খানেক আগেও দাম ছিল ৩৯০ থেকে ৪০০ টাকা।
এলাচ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৮০০ টাকায়, যা রোজায় ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা ছিল। সপ্তাহ দুয়েক আগে ১ হাজার ১০০ টাকার লবঙ্গ বিক্রি হলেও, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা বেশি দরে।
দারুচিনি বিক্রি হয়েছে ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা/কেজি দরে, যা সপ্তাহ দুয়েক আগেও বিক্রি হয়েছিল ৩৬০ টাকায়।
এলসি মার্জিন নিয়ে অস্পষ্টতা
চট্টগ্রামের মসলা আমদানিকারক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অমর কান্তি দাশ দাবি করলেন, বিভিন্ন ধরনের মসলা আমদানির জন্য আগে ১০ থেকে ২৫ শতাংশ মার্জিনে এলসি খোলা গেলেও এখন ৫০ শতাংশ মার্জিনের নিচে এলসি খোলা যাচ্ছে না।
“আমি কয়েকটি ব্যাংকের সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছে, সব ধরনের মসলার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ মার্জিনে এলসি খুলতে হবে।”
ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে আমদানিতে লাগাম টানার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ১০ মে বিভিন্ন পণ্যের এলসি (ঋণপত্র) খুলতে নগদ মার্জিন হার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়।
সেখানে বলা হয়, সেডান কার বা এসইউভি এর মত মোটর গাড়ি এবং ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স হোম অ্যাপ্লায়েন্স আমদানিতে ঋণপত্র খুলতে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে হবে।
আর জরুরি ও সুনির্দিষ্ট খাতের কিছু পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্যের আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র খুলতে ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
শিশুখাদ্য, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, স্থাস্থ্য অধিদপ্তর স্বীকৃত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও সরঞ্জামসহ চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, উৎপাদনমুখী স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সরাসরি আমদানিকৃত মূলধনী যন্ত্রাপাতি ও কাঁচামাল, কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট পণ্য এবং সরকারি অগ্রাধিকার প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা পণ্য শর্তের বাইরে রাখা হয়।
মসলার ক্ষেত্রে মার্জিন কত হবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায়। অমর দাশের দাবি, তাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ৫০ শতাংশ হারেই মার্জিন রাখছে।
“মসলা কম প্রচলিত পণ্য। এক কন্টেইনার মসলা জাতীয় পণ্য আমদানি করে বিক্রি করতে অনেক সময় লেগে যায়। কিন্তু দাম বাড়লে, ক্রেতারা কেনার পরিমাণ কমিয়ে দেয়। আবার যথা সময়ে পণ্য ছাড় না করালে বন্দরে অতিরিক্ত টাকা জরিমানা দিতে হয়। এগুলোর প্রভাব পড়ে বাজারে।”
তবে ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে তার ওই দাবির সঙ্গে পুরোপুরি মিল পাওয়া যায়নি।
ব্যাংক এশিয়ার খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক ফারুক আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে নিত্য প্রয়োজনীয় এবং কৃষিজাত পণ্যের বিষয়ে সুস্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। তাই আমরা বেশি ব্যবহার হয় এমন মসলা যেমন জিরা ও দারুচিনির ক্ষেত্রে আগের হারে এলসি খুলছি। আর যেসব মসলা নিত্য প্রয়োজনীয় নয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারণ করা ৫০ শতাংশ হারে মার্জিন ধরে এলসি করতে হচ্ছে।”
তবে বিষয়টি যে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম ধরে চলছে না, তা বোঝা গেল চট্টগ্রামের আরেকটি ব্যাংকের এক কর্মকর্তার কথায়।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে অষ্পষ্টতা আছে। সেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় হিসেবে কোন ধরনের পণ্য বিবেচিত হবে সেটার উল্লেখ নেই। তাই এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এলসি খোলার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রধান কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কও এখানে একটি ফ্যাক্টর।”