অন্যদিকে আট বছর আগে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিত ১৬ আসামিকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরের বিলাসী সিনেমা হলের সামনে ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি একরামকে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে, কুপিয়ে ও গাড়িসহ পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
ওই ঘটনায় নিহতের বড় ভাই জসিম উদ্দিনের করা হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ ফেনীর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আমিনুল হক ৩৯ আসামিকে ফাঁসির দণ্ড দেন। সেই সঙ্গে মামলার প্রধান আসামি বিএনপি নেতা মাহতাব উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী মিনারসহ ১৬ জন বেকসুর খালাস দেন।
নিহত একরামের বড় ভাই মামলার বাদী রেজাউল হক জসিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রায় ঘোষণা পরবর্তী আসামিদের আপিল করার পর, উচ্চ আদালতে এই মামলার ফাইল নিচে পড়ে যায়। পলাতক আসামিরাও গ্রেপ্তার হয়নি। সে কারণে আমরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
এদিকে একরামের মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে শুক্রবার তার গ্রামের বাড়িতে পরিবারের পক্ষ থেকে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। তবে এলাকার মসজিদগুলোতে নামাজের পর বিশেষ মোনাজাত ছাড়া দলীয় তেমন কোন কর্মসূচি নেওয়া হয়নি বলে ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল আলিম জানিয়েছেন।
একরাম হত্যার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ২২ জন কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া সাতজন জামিনে মুক্ত হয়ে পলাতক আছেন; আর নয়জন শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন।
ফেনী জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর হাফেজ আহম্মদ জানান, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের পলাতক ১৬ জন হলেন- ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিদ হোসেন জিহাদ, ফেনী-২ আসনের সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারির মামাতো ভাই আবিদুল ইসলাম আবিদ, চৌধুরী মো. নাফিজ উদ্দিন অনিক, আরমান হোসেন কাউসার, জাহেদুল হাসেম সৈকত, জসিম উদ্দিন নয়ন, এমরান হোসেন রাসেল ওরফে ইঞ্জিনিয়ার রাসেল, রাহাত মো. এরফান ওরফে আজাদ, একরাম হোসেন ওরফে আকরাম, শফিকুর রহমান ওরফে ময়না, কফিল উদ্দিন মাহমুদ আবির, মোসলে উদ্দিন আসিফ, ইসমাইল হোসেন ছুট্টু, মহিউদ্দিন আনিছ, বাবলু ও টিটু।
একরাম হত্যা: চার বছরেও অধরা দণ্ডিত ১৭ আসামি
এদের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে একেবারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত জাহিদ হোসেন জিহাদ ও আবিদুল ইসলাম আবিদসহ কয়েকজন পালিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে বলে এলাকাবাসীর ধারণা।
এদিকে ঘটনার ৭ বছর পর ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জিয়াউর রহমান বাপ্পিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পলাতক অপর আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ বদরুল আলম মোল্লা জানান।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার রায়ে বলা হয়, স্থানীয় নির্বাচন থেকে আসামিদের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধের কারণেই একরামকে হত্যা করা হয়েছে।
রায় ঘোষণার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিচারিক আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্সের নথি হাই কোর্টে পাঠানো হয়।
ডেথ রেফারেন্স নথির ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুত হলেই হাই কোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল শুনানি হবে বলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান।
এই হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডিত কারাবন্দি ২২ জন হলেন- হত্যার পরিকল্পনাকারী জেলা আওয়ামী লীগের ততকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির আদেল, ফেনী পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ হিল মাহমুদ শিবলু, সাজ্জাদুল ইসলাম পাটোয়ারী ওরফে সিফাত, আবু বক্কার সিদ্দিক ওরফে বক্কর, মো. আজমির হোসেন রায়হান, মো. শাহজালাল উদ্দিন শিপন, জাহিদুল ইসলাম জাহিদ ওরফে আজাদ, কাজী শানান মাহমুদ, মীর হোসেন আরিফ ওরফে নাতি আরিফ, আরিফ ওরফে পাঙ্কু আরিফ, রাশেদুল ইসলাম রাজু, মো. সোহান চৌধুরী, জসিম উদ্দিন নয়ন, নিজাম উদ্দিন আবু, আবদুল কাইউম, নুরউদ্দিন মিয়া, তোতা মানিক, মো. সজিব, মামুন, রুবেল, হুমায়ুন ও টিপু।
২০১৪ সালের ২০ মে রাতে একরাম হত্যার পর তার ভাই রেজাউল হক জসিম বাদী হয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপি নেতা মিনারের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় ৩০-৩৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ওই বছরের ২৮ অগাস্ট তদন্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ৫৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
তিন দফা শুনানির আড়াই মাস পর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে এবং ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বিচার শুরু হয়।
মামলায় বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও র্যাব ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এদের মধ্যে জামিনে নিয়ে বেরিয়ে পালিয়ে যান নয়জন। এ মামলার অন্যতম আসামি সোহেল ওরফে রুটি সোহেল র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় ১৫ জন।
মামলার বাদী একরামের বড় ভাই রেজাউল হক জসিম, ছোট ভাই এহসানুল হক, একরামের স্ত্রী তাসমিন আক্তার, গাড়ি চালক আবদল্লাহ আল মামুনসহ ৫০ জন সাক্ষ্য দেন।
একরামের ছোট ভাই মোজাম্মেল হক বলেন, তার ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড শুধু দেশে নয়, বিশ্ব মিডিয়াতে ব্যাপক আলোচিত সমালোচিত হয়েছিল। দোষিরা উপযুক্ত শাস্তি পেলেও ঘটনার হোতা পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা যেন উচ্চ আদালত থেকে কোন ভাবে রেহাই না পায় সেদিকে সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। সেই সঙ্গে রায় দ্রুত কার্যকর করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।