আ হ ম মুস্তফা কামাল, ফাইল ছবি
২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট নিয়ে বৃহস্পতিবার দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ার সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এই প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সবার পরামর্শের সংযোগ ঘটিয়ে সঙ্কট উত্তরণের পরিকল্পনা সাজাবেন তিনি।
“অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাব। সবাই মিলে একসাথে কাজ করব। এবার যা দেখতে পেয়েছেন আগামীতে আরও স্ট্রংলি কাজ করব। আমাদের বাজেট হবে রেসপনসিবল, অ্যাকাউন্টেবল অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্ট।”
সভায় আলোচনায় দেশের অর্থনীতির উপর আস্থা ফেরানোর আর্থিক নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের সামর্থ্য বাড়ানোর পরামর্শ দেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, আমাদের অর্থনীতিতে আস্থা ফেরানোর মতো নীতি প্রণয়ন করতে হবে, আর ভবিষ্যতের যে কোনো সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের সামর্থ্যকে শক্তিশালী করতে হবে।”
সময়টি যে অন্য যে কালের চেয়ে আলাদা, বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা উপলব্ধি করে গতানুগতিকতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শও দেন তিনি।
বৈশ্বিক সঙ্কটের অভিঘাতে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে লাগা ধাক্কার বিষয় মনে করিয়ে সেসব ক্ষেত্রে উত্তরণের জন্য বাজেটে পরিকল্পনা সাজানোর পরামর্শ আসে তার আলোচনায়।
তৌফিক খালিদী বলেন, “এই বছর হতে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার বছর, কৃচ্ছ্রতার বছর। আগের বছরগুলোতে আমরা যেভাবে খরচ করেছি, যেভাবে করতে পারব না।
“কর বসাও আর ব্যয় কর- এমনটা করা যাবে না, এটা এবার নিশ্চিত করে বলা যায়। আমরা আশা করতে পারি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দামের অভিঘাত থেকে রক্ষার পরিকল্পনা আপনি দেবেন। কেননা, কিছু কিছু জিনিসের দাম অনেক বেড়ে গেছে।”
তৌফিক খালিদী বলেন, “আমরা দেখতে চাইব, মহামারীর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং যুদ্ধের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার কীভাবে পরিকল্পনা নেয়।
আর্থিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্নও সামনে আনেন তৌফিক খালিদী। জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি এবং স্বাস্থ্যে যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, বাজেট পরিকল্পনায় তা গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
ইউক্রেইনে যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তাতে সরকারকে নতুন করে ভাবার পরামর্শ দেন তৌফিক খালিদী। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করা যায়, তা খোঁজার পরামর্শও দেন তিনি।
সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের সামর্থ্য বাড়াতে হবে: তৌফিক খালিদী
দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, এই সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি, অর্থনীতিতে একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
“একটা প্যানিকড পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্যানিক সিচুয়েশনে আশাবাদের কথা বলার পাশাপাশি সুনির্দিষ্টভাবে বাজেটে এই অনিশ্চয়তা বা অর্থনীতির ক্ষেত্রে বৈশ্বিক দুরবস্থা মোকাবেলা করার জন্য আপনাদের পদক্ষেপগুলো বাজেটে পৃথকভাবে উল্লেখ করবেন।”
নাইমুল ইসলামসহ মুদ্রিত সংবাদপত্রের সম্পাদকরা তাদের খাতের নানা দাবি-দাওয়া অর্থমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন।
চ্যানেল আইর বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ বলেন, “পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় আমরা খাদ্য নিরাপত্তায় হয়তো এগিয়ে আছি। কিন্তু এই জায়গাটাতে কতদিন থাকব, সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ সবকিছুর দাম বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা খুব জরুরি। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে।”
সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু বলেন, দেশে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। ভালো অবকাঠামোর পাশাপাশি সরকারি অন্যান্য পরিষেবাগুলোর পরিধি বাড়াতে হবে। দুর্ঘটনা, যানজট ও অন্যান্য সমস্যা দূর করতে গুণগত পরিকল্পনা প্রয়োজন।
সবার কথা শুনে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে বাজেট তৈরি করি। সবাইকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। কাউকে পেছনে রেখে নয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, কৃষি, কর্মসংস্থা বৃদ্ধি এবং ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে আসছি।
তিনি বলেন, “যেসব পণ্য দেশে তৈরি হয়, সেগুলোর উপর ফিসক্যাল সাপোর্টটা স্ট্রংলি দেই, অনেকটা হাজি মুহম্মদ মুহসিনের মতো। আমরা চাই এখানে শিল্প কারখানা হোক, ছেলে মেয়েরা কাজ করুক। সেজন্যেই উদ্দীপনাগুলো দিয়ে আসছি।”
সম্পাদকদের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি তাদের কাছে ‘সততার’ প্রচারও প্রত্যাশা করেন অর্থমন্ত্রী।
“আমি অনুরোধ করব, আপনারা মানুষকে সৎ পথে চলার জন্য বলুন। এটাও একটা ধর্মীয় কাজ।”
সম্প্রতি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিপরীতে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে বলে যে খবর আসছে, তারও উত্তরও দেন মুস্তফা কামাল।
“বলা হচ্ছে রেমিটেন্স ডাউনওয়ার্ড। রেমিটেন্স কিন্তু ডাউনওয়ার্ড না। ১০ বছর আগে এটা ছিল ১৪ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে ২৪ বিলিয়নে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে কমে ২১ বিলিয়নে এসেছে।”
তিনি বলেন, “জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এটা কীভাবে ম্যানেজ করব? আমরা কোনোভাবেই এককভাবে কোনো কনজুমারের উপর চাপাব না। কিন্তু এখন এতগুলো ভালনারেবলিটি যদি একসাথে আসে, তাহলে সেটা তো ট্যাকল করা খুব কঠিন। কিন্তু আমরা ব্যর্থ হব না। আপনাদের সাথে নিয়েই এগিয়ে যাব। আগেও বিজয়ী হয়েছি, এবারও বিজয়ী হব।”
সঙ্কটকালীন বাজেটে সবগুলো খাতে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
“সামাজিক সুরক্ষা থেকে শুরু করে প্রতিটি খাতের জন্য বিকল্প ব্যবস্থাপনা আমাদের আছে। আমরা প্রয়োজনে এগুলোকে কাজে লাগাবো। যেখান থেকে প্রয়োজন হয় বেরিয়ে যেতে হলে বেরিয়ে যাবো। সংযুক্ত হওয়ার প্রয়োজন হলে সংযুক্ত হতে পারব।”
‘শ্রীলঙ্কার সাথে বাংলাদেশের মেলে না’
সম্প্রতি রাষ্ট্র হিসাবে দেউলিয়া হয়ে পড়া শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যত ঝুঁকির তুলনা করাকে অনেকটা অবান্তর বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী।
আলোচনায় নিজ থেকেই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করে তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কার সাথে আমাদের অনেক পার্থক্য। আমরা শ্রীলঙ্কাকে অর্থ সহায়তাও দিয়েছি। দীর্ঘদিন ধরে তাদের ইনফ্লাশন রেট ৩১ শতাংশ। পাকিস্তানের ১৪ শতাংশ, ভারতের ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর আমাদের ৬ শতাংশের ওপরে যায়নি।
“আমরা যে ঋণগুলো নিয়েছি, আমাদের জিডিপি সাইজ অনুযায়ী সেটা ৩৪ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বনিম্ন। অতীতে ক্যাশ সার্ভিসিংয়ে আমরা ব্যর্থ হয়নি। সেটা প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট কিংবা সুদ কোনো ধাপেই। সবগুলোই সময় মতো আমরা দিয়েছি।”
তিনি বলেন, “আমরা যে ঋণগুলো নিয়েছি, সেটা উৎপাদনশীল প্রকল্পের জন্য। প্রকল্পগুলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে কিনা, রেভিনিউ জেনারেট করবে কি না, খরচ বা ব্যয় কমাবে কি না, এসব মূল্যায়ন করে আমরা প্রকল্পগুলো হাতে নিই। আমাদের ঋণের ৭৭ শতাংশই হচ্ছে সফট লোন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, জাইকা- এজাতীয় ব্যাংক থেকে আমরা টাকা নিয়েছি। আর শ্রীলঙ্কা টাকা নিয়েছে কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে। ওদের সবটাই হার্ড লোন।”
“তাই শ্রীলঙ্কা ইস্যুতে রিউমারগুলো এখানে সেখানে আপনারা ছড়াবেন না। কারণ রিউমার থেকে খারাপ কিছু হয়। মানুষ কষ্ট পাবে। আমরা কষ্ট দিতে চাই না,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২১ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ১৭ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ এসেছে। সবশেষ গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।
তবে এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধে সরকারকে কোনো বেগ পেতে হবে না বলেই মনে করেন অর্থমন্ত্রী।
আগামী চার বছরের ঋণ পরিশোধের হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, “চলতি মে মাসেও আমাদের রেমিটেন্স আসবে ২ বিলিয়ন ডলার। এবছর আমাদের লোন সার্ভিসিং করা লাগবে ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, আগামী বছর ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, এর পরের বছর লাগবে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, এরপরের বছরের লাগবে ৪ বিলিয়ন ডলার। তাহলে দুই মাসের রেমিটেন্সের টাকা থেকেই আমাদের এসব ঋণ শোধ করা যায়। আমাদের রিজার্ভ আছে ৪৪ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয় আছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। আমাদের এই সক্ষমতাগুলো রয়েছে।”
বিশ্বে মূল্যস্ফীতির হিসাবগুলোতে দেখা যায়, জাতিসংঘের হিসাবে এবছর বিশ্বে খাদ্যদ্রব্যের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে, বিশ্ব ব্যাংক বলছে- বিশ্বে গত বছর গমের মূল্য বেড়েছে ৭০ শতাংশ, গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৩৩ শতাংশ, মুরগির মাংস ১০১ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৬৭ শতাংশ, চিনি ২৩ শতাংশ, টিএসপি সার ১০৬ শতাংশ, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ।
মুস্তফা কামাল বলেন, “বাজার অর্থনীতিতে এই জিনিসগুলোতে আমরাও ভুগব। এগুলো আমাদেরকেও স্পর্শ করে। এককভাবে আমরা দেশ চালাতে পারব না। সারা বিশ্বের সাথে মিলে মিশে চলতে হবে।”