ক্যাটাগরি

শতবর্ষের সারিন্দা

এমন দুর্লভ ১২টি সারিন্দা এবার তুলে ধরা হয়েছে ময়মনসিংহের একটি প্রদর্শনীতে। আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে নগরীর কাঁচিঝুলি রোডের ব্যাপ্টিস্ট চার্চ গির্জার নিচতলায় ‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’ গ্যালারি হলে চলছে এই প্রদর্শনী।

প্রদর্শনীতে প্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রও স্থান পেয়েছে। প্রদর্শনীর পাশাপাশি পুঁথিপাঠ, বাউল বৈঠক, যন্ত্রসংগীত ও সংগীতের মুর্ছনারও আয়োজন করা হয়েছে। নোভিস ফাউন্ডেশন ও ময়মনসিংহ বাউল সমিতি এতে সহায়তা দিয়েছে।

সংগ্রাহক রেজাউল করিম আসলাম দাবি করেন, যে ১২টি সারিন্দা প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হয়েছে সেগুলো সতের থেকে উনিশ শতাব্দীর।

বাদ্যযন্ত্র ও লোকজ সংস্কৃতির সংগ্রাহক রেজাউল করিম আসলাম বলেন, “কুড়িগ্রামের রহমান ফকিরের কাছ থেকে পাওয়া সারিন্দাটি প্রায় ৩৬৫ বছরের পুরনো। লালমনিরহাটের গুণধর বাবুর কাছ থেকে পাওয়া সারিন্দার বয়স ৩০০ বছরের কাছাকাছি। শত বছরের এমন পুরনো সারিন্দা আমি সংগ্রহ করি। দুর্লভ বিধায় সেগুলো মানুষের দেখার জন্য প্রদর্শনীতে নিয়ে এসেছি।”

তিন পুরুষ ধরেই বংশ পরম্পরায় বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে জড়িত আসলামের পরিবার। ময়মনসিংহ শহরের বড়বাজারে রয়েছে তাদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘নবাব অ্যান্ড কোং’। সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করা হয় এখানে।

আসলাম জানান, ১৯৪৪ সালে তার দাদা নবাব আলী এখানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তার বাবা সেই ব্যবসার হাল ধরেন। এখন তিনি এর কর্ণধার।

২০০৬ সাল থেকে বিরল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ শুরু করেন জানিয়ে আসলাম বলেন, “অনেক সারিন্দা কারও রান্নাঘর, কারও গোয়ালঘর, কারও উগার বা সিলিং থেকে সংগ্রহ করেছি। অনেক সারিন্দা চুলার লাকড়ির মধ্যে পড়েছিল। কোনোটা আবার পড়ে থাকতে থাকতে মাটিতে মিশে গিয়েছিল। সেগুলো এনে সংরক্ষণ করেছি।” 

“যাদের কাছে এসব বাদ্যযন্ত্র পাওয়া গেছে তারা জানে না এর ঐতিহাসিক বা ঐতিহ্যগত মূল্য কত। এই প্রদর্শনী থেকে যদি কেউ জানতে পারে তাহলে আমাদের পুরনো সারিন্দাগুলো আর বিলুপ্ত হবে না। তারাও হয়তো যত্ন করে রাখবে। আর নতুন প্রজন্মের কাছে এই দেশীয় বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে আগ্রহ তৈরি হবে।”

‘সারিন্দা’ সম্পর্কে বাংলাপিডিয়ায় লোকসংস্কৃতির গবেষক ওয়াকিল আহমেদ লিখেছেন, “সারিন্দা তত জাতীয় (তারের বাদ্যযন্ত্র)  লোকবাদ্যযন্ত্র। একটি কাঠের ফ্রেম, চামড়া, তার ও ছড় এর প্রধান উপকরণ। মূল কাঠামোর প্রশস্ত অংশ দুপাশে বেশ চাপা থাকে, ওপরে থাকে চামড়ার ছাউনি।

“এর বাকি অংশ দণ্ডাকৃতির, মাথায় থাকে পাখি বা ঘোড়া, এমনকি যেমন রাধা-কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি খোদাই করা হয়। প্রশস্ত অংশের নিচে ফেসির সাহায্যে তিনটি তার বেঁধে চামড়ার ওপর দিয়ে টেনে কাঠামোর অপর প্রান্তে কানের সঙ্গে এঁটে বাঁধা হয়।”

এতে আরও বলা হয়, সারিন্দা বাজানো হয় ছড়ের সাহায্যে। ধনুকাকৃতির এই ছড় পশুর লেজের চুল বা রেশম সুতা দিয়ে তৈরি। সাধারণত  বিচার গান,  মুর্শিদি গান, নৌকাবাইচের গান,  কবিগান ইত্যাদিতে অনুষঙ্গী যন্ত্র হিসেবে সারিন্দা বাজানো হয়; তবে স্বতন্ত্রভাবেও এতে গানের সুর তোলা যায়। 

তিনদিনব্যাপী প্রদর্শনীটি বুধবার থেকে শুরু হয়েছে। শেষ হচ্ছে শুক্রবার। সারাদিনই মানুষ প্রদর্শনীতে আসছে এবং লোকসংস্কৃতি, এখানকার সংগীত, যন্ত্রসংগীত, বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারছে। প্রদর্শনীতে বিলুপ্ত ও প্রচলিত ৬০০ বাদ্যযন্ত্র উপস্থাপন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

সারিন্দার পাশাপাশি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে সন্তর, শরৎ, সানাই, বেহেলা, তবলা, বিনা, সারেঙ্গি, সেতার, তানপুরা, একতারা, গিটার, বাঁশিসহ আরও অনেক বাদ্যযন্ত্র।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালার ডেপুটি-কিপার মুকুল দত্ত বলেন, “এই ধরনের আয়োজন আরও বেশি হওয়া উচিত। এর মূল বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছলে আমাদের লোকজ সম্পদ ও লোকজ ঐতিহ্য রক্ষা পাবে।

“সারিন্দা নিয়ে প্রবাদ আছে, ‘আমি কই কী, আর আমার সারিন্দা বাজায় কী।’ প্রবাদটির অর্থ হলো- কথায় ও সঙ্গতে মিল নেই। অর্থাৎ আমরা যা বলি তার সঙ্গে কাজের মিল নেই। প্রবাদটি সবার কাছে পরিচিত হলেও যে বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে এটি রচিত সেই সারিন্দা যন্ত্রটি সবার কাছে তত পরিচিত নয়; অনেকের কাছে অপরিচিত। কালের বিবর্তনে এটি হারিয়ে যেতে বসেছে।”

তরুণ শিল্পী জয়িতা অর্পা বলেন, “এটি একটি ব্যতিক্রম প্রদর্শনী। এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। সারিন্দা সম্পর্কে অনেক ধারণা নিতে পারছি। এগুলো সম্পর্কে আমাদের আগে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। এসব প্রদর্শনী নিয়মিত হলে নিজেদের সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে ভালো জানতে পারবে মানুষ।”

বাউল শিল্পী সুনীল কর্মকার বলেন, সারিন্দা বাঙালির প্রাচীনতম বাদ্যযন্ত্র। এটি সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এসব যন্ত্র সংরক্ষণ করে রাখা খুবই জরুরি। সংরক্ষণ করে না রাখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে না যে তাদের নিজস্ব একটা বাদ্যযন্ত্র ছিল। এসব যন্ত্র সম্পর্কে কেউ জানলে, তাহলে সে নিজেরে জানল এবং নিজে কিছু শেখার সুযোগ পেল।”

“সাড়ে ৩০০ বছর আগে সারিন্দার ভালো প্রচলন ছিল। এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমরা গুরুজনের সঙ্গে আলোচনায় মনে করি সারিন্দা শেখা আমাদের খুব দরকার। প্রদর্শনীতে এসে বুঝতে পারলাম এটার গুরুত্ব অনেক। আমাদের মতো যারা রয়েছে সবার উচিৎ এ বিষয়ে অবগত থাকা। এখানে এসে অনেক উৎসাহিত হচ্ছি। শিল্পী মনে সারিন্দা শেখার বাসনা জাগছে।”

বাউল শিল্পী আবুল কাশেম সরকার বলেন, “এমন আয়োজন শিল্পীমনকে প্রফুল্ল করে। প্রদর্শনীর মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রকে মানুষ নতুন করে জানতে পারবে। এ থেকে আমাদের অনেক শিক্ষণীয় রয়েছে।”