বলকানের ভূ-রাজনীতি এবং যুগোস্লাভিয়া নামক রাষ্ট্রটির উত্থান ও পতনকে কাছ থেকে জানতে হলে অবশ্যই এ দেশটি ভ্রমণ করতে হবে।
কাগজে-কলমে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা একক রাষ্ট্র, বাস্তবে ১৯ হাজার ৭৬৭ বর্গমাইলের এ ভূখণ্ডে তিনটি রাষ্ট্র বিরাজমান। আয়তনে যে দেশটি বাংলাদেশের প্রায় তিনভাগের একভাগ, সে-ই দেশে তিনজন রাষ্ট্রপতি শাসনকার্য পরিচালনা করেন এটা ভাবতে অবাক লাগে। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা প্রকৃতপক্ষে বসনিয়াক, সার্ব এবং ক্রোয়াট- এ তিনটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র।
এমনিতে বসনিয়াক, সার্ব, মন্টিনিগ্রিন ও ক্রোয়াট- এ চার জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মাঝে তেমন কোনো ভিন্নতা নেই। জাতিগতভাবে তাদের প্রত্যেকে স্লাভ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে মন্টিনিগ্রিন, সার্বিয়ান, বসনিয়ান এবং ক্রোয়েশিয়ান- এ চারটি ভাষা আলাদাভাবে পরিচিতি পেলেও আদতে এ চারটি ভাষার মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই।
সাবেক যুগোস্লাভিয়ার সময় এ সকল ভাষাকে সমন্বিতভাবে সার্বো-ক্রোয়েশিয়ান নামে ডাকা হতো।
বসনিয়াকরা মূলত ইসলাম ধর্মকে অনুসরণ করেন। অন্যদিকে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর বেশিরভাগ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিস্টানিটিতে বিশ্বাস করেন। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাতে যে সকল সার্ব রয়েছেন তারাও অর্থোডক্স চার্চকে অনুসরণ করেন। আর ক্রোয়াট হিসেবে যারা পরিচিত তারা ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী।
লেখক ও ট্যুর গাইড কেমাল।
ইউরোপের দেশ বসনিয়ার অবকাঠামো খুব একটা উন্নত নয়। অর্থনৈতিক শহর হিসেবে পরিচিত জেনিছার সাথে রাজধানী সারায়েভোর সংযোগ সড়কটি বাদ দিলে দেশটিতে হাইওয়ে নেই বললে চলে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বসনিয়ার রাস্তাঘাটের মানও অনেক পিছিয়ে।
সারায়েভোর সাথে সরাসরিভাবে সেব্রেনিৎসার গণপরিবহণ সংযোগ নেই। শোঅ্যারাউন্ড নামক এক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে কামের ও কেমাল নামক দুই বসনিয়াক তরুণের সাথে আমার পরিচয় হয়। বসনিয়া ভ্রমণকালে তাদের থেকে সহায়তা পেয়েছি। তাদের কারণেই সেব্রেনিৎসা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
বসনিয়া ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় খরচের সম্পূর্ণটা আমার রুমমেট ও এক ক্লাসফ্রেন্ডের থেকে ধার করেছিলাম। ধারের অর্থ শোধ করেছি, তবে এখনও তারা জানে না যে তাদের থেকে ধার নিয়ে আমি বসনিয়া থেকে ঘুরে এসেছি।
সেব্রেনিৎসাতে পা রাখতে আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ছিল। পাহাড়ঘেঁষা ছবির মতো সুন্দর এক শহর, অথচ এখানকার ছিমছাম অধিবাসীরা বুকে বয়ে নিয়ে চলেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এক গণহত্যার ইতিহাস। ঠিক কতোজন মানুষ সার্ব সেনাদের হাতে নিহত হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
কেমাল জানালেন, সেব্রেনিৎসা ও ব্রাটুনাচসহ আশেপাশের এলাকাগুলোতে সব মিলিয়ে পঁচিশ হাজার বসনিয়াক মুসলমান গণহত্যার শিকার হয়েছে যদিও এখন পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার মানুষের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। এছাড়াও কমপক্ষে ৭০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন।
শুধু সেব্রেনিৎসাতে সাড়ে ৮ হাজারের মতো মানুষ সার্ব সেনবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। নারী, পুরুষ ও শিশু থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির বসনিয়াক মিলোশেভিচের বাহিনীর হাতে নির্বিচারে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকের পরিচয় আজও খুঁজে পাওয়া যায় নি। এখনও অনেকে নিখোঁজ। সবাইকে গণকবর দেওয়া হয়েছে।
বসনিয়াক বন্ধু কেমাল বললেন, “সার্ব সেনাদের বর্বরোচিত আক্রমণে পুরুষ ও শিশুরা ওপর সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। কেননা তাদের ধারণা ছিল, পুরুষেরা যুদ্ধে অংশ নিতে সক্ষম। তাই তারা যাতে কোনও ধরণের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে সেজন্য তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। অন্যদিকে, ভবিষ্যতে বসনিয়াক মুসলিমরা সংখ্য্যায় বৃদ্ধি পেতে পারে সে শঙ্কা থেকে শিশুদেরকেও তারা টার্গেটে পরিণত করেছিল। গর্ভবতী মায়েদেরকেও তারা নৃশংসতা থেকে মুক্তি দেয় নি। এমন অনেক নারী আছেন যাদের চোখের সামনে তাদের পেটের বাচ্চাকে হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য নারীকে সার্ব সেনারা ধর্ষণ করেছে এবং তাদেরকেও জীবন দিতে হয়েছে।”
পাহাড়ের কোলঘেঁষা ছবির মতো সুন্দর বসনিয়ার সেব্রেনিৎসা নামের এ শহরটিতেই সার্বরা চালিয়েছিল গণহত্যা।
২০০১ সালে সেব্রেনিৎসা ও এর আশেপাশের অঞ্চলে মিলোশেভিচের বাহিনীর হাতে প্রাণ হারানো এ সকল বসনিয়াক মুসলমানকে স্মরণ করতে একটি মেমোরিয়াল স্থাপন করা হয়। এখন পর্যন্ত যাদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে, তাদের সকলের নাম মেমোরিয়ালের ভেতর লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
প্রত্যেকটি কবরে নামফলকের পাশাপাশি আরবি ও বসনিয়াক ভাষায় বিভিন্ন দোয়া খোদাই করা হয়েছে।
প্রত্যেক বছরের জুলাই মাসের এগারো তারিখে গণহত্যার শিকার হওয়া মানুষদের স্মরণ করতে পুরো বসনিয়া থেকে হাজারো মুসলিম সেব্রেনিৎসায় জড়ো হন এবং জানাজার নামাজ আদায়ের পাশাপাশি মৃতদের জন্য দোয়া করেন।
গণহত্যার শিকার হওয়া বসনিয়াকদের স্মরণ করতে মেমোরিয়ালের উল্টো পাশে রাস্তার অপর প্রান্তে একটি পরিত্যক্ত ব্যাটারির কারখানাকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। মেমোরিয়াল এবং জাদুঘর দুটি স্থান দর্শনার্থীদের জন্য সম্পূর্ণভাবে উন্মুক্ত।
জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই সেখানে দায়িত্বরত এক তরুণী জানান কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ থেকে কয়েকজন সমবেতভাবে সেব্রেনিৎসা ঘুরে গিয়েছেন। আমাদেরকে তিনি ওই গণহত্যার সময়ে ধারণ করা ডকুমেন্টারি ও ভিডিও ক্লিপ দেখালেন। ওই সময়ের বিভিন্ন ছবি দিয়ে এ জাদুঘর সাজানো হয়েছে।
যুগোস্লাভ যুদ্ধের সময় সেব্রেনিৎসা ও ব্রাটুনাচসহ বিভিন্ন স্থানে ঘরবাড়ি ও দালানকোঠা থেকে শুরু অসংখ্য স্থাপনা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। এখনও এ সকল স্থানে যুদ্ধকালীন ধ্বংসপ্রাপ্ত বিভিন্ন স্থাপনার দেখা মেলে। প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাবে দেশটির সরকারের পক্ষে সেগুলোকে মেরামত করা সম্ভব হয়নি।
সার্বরা এখনও স্বীকার করে না যে সেব্রেনিৎসাসহ গোটা বসনিয়ায় গণহত্যা হয়েছে। এমনকি বসনিয়া হার্জেগেভিনারই আরেক অংশ রিপাবলিক অব সার্পসকার বিভিন্ন স্থানে আজও মুসলিমরা আজও সার্বদের হাতে বিভিন্নভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেব্রেনিৎসাতে যে সকল বসনিয়াক বসবাস করেন তাদেরকে স্থানীয় সার্বরা মাঝেমধ্যে উচ্ছেদের হুমকি দেন বলেও আমার বসনিয়ান বন্ধুরা জানিয়েছিল।
আমার ভ্রমণের দিনটি শুক্রবার হওয়ায় জুমার দিন নামাজ শেষে সেব্রেনিৎসা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম। অনেক মুসলিম সমাজেই জুমার নামাজ শেষে মৃত আত্মীয়-স্বজনদের কবর জিয়ারতের একটি রীতি রয়েছে।
সার্বিয় সেনাবাহিনীর হাতে নিহত বসনিয়াক মুসলিমদের কবর।
বলকানের দেশ বসনিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। মেমোরিয়ালের ভেতরে এক স্থানে এসে একটি সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম। সেখানে বসনিয়ার ভাষায় লেখা কয়েকটি লাইনের দিকে চোখ পড়তে অঝোরে কেঁদে দিয়েছিলাম। সেখানে লেখা ছিল-
পৃথিবীর ইতিহাসে যাতে আরেকটি সেব্রেনিৎসা নেমে না আসুক এবং কোনো মায়ের চোখের সামনে যাতে তার সন্তান হত্যাযজ্ঞের শিকার না হোক সে কামনা করি। কোনও মানুষের অপমৃত্যু কখনও কাম্য নয়।
ওই লেখাটি পড়তে গিয়ে বসনিয়াক বন্ধু কেমালও এ সময় অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন, যুগোস্লাভ যুদ্ধে সার্ব মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে তার মামা প্রাণ হারিয়েছেন।
লেখক পরিচিতি: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স,
ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া
ছবি: লেখক
লেখকের ইমেইল: rakib.rafi786@gmail.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |