ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি বৃহস্পতিবার প্রকাশ করলে তা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। ৫৫ বছর
বয়সে ‘ভর্তিযুদ্ধে’ নামায় বহু মানুষ তাকে যেমন শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, তেমনি উৎসাহ
দিচ্ছেন লেগে থাকার জন্য।
শুক্রবার বিকালে গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখণ্ড এলাকায় বাড়িতে গিয়ে কথা হয় বেলায়েতের সঙ্গে। কথায়
কথায় জানালেন, বেশি বয়সে পড়াশোনা নিয়ে তাকে
এলাকার অনেকের তিরস্কার ও নানা কটুক্তি শুনতে হয়েছে। কাছের মানুষজনও তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত। এসব এড়াতেই তিনি এলাকার প্রতিষ্ঠানে না পড়ে ঢাকায় ভর্তি হন।
মনোবল ধরে রাখার ‘কৌশল’ বলতে গিয়ে বেলায়েত বললেন, “আমার নিজেকে বয়ষ্ক লাগে না; ইয়াংয়ের মতোই লাগে। কিছু চুল পেঁকে গেছে, এগুলো কালি দিয়ে রাখি। কারণ কালি দিয়ে না রাখলে এগুলোর জন্য নিজেকে বয়ষ্ক মনে হয়। আর তখন মনটা দুর্বল হয়ে যায়।”
সন্তান বয়সী সহপাঠীদের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে
নিতেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, “যাদের সঙ্গে
ক্লাস করেছি, তাদের কাছ থেকে খারাপ কোনো অভিজ্ঞতার শিকার
হইনি। আমার সঙ্গে যেসব মেয়ে ক্লাস করে, তারা আমাকে ‘আঙ্কেল’ ডাকে। আর আমি তাদের ‘আম্মু’ ডাকি।
“এক ছেলে আমাকে ‘বুড়া’ ডেকেছিল। পরে
তাকে আমি বলেছি, এই আমি কি বুড়া হইছি? আমাকে ‘দাদা ভাই’ না হয় ‘বড় ভাই’ বা ‘আঙ্কেল’ ডাকবা। এটা নিয়ে তারা বেশ হাসাহাসি করতো।”
পরিবারের লোকজন, সন্তানরাও শুরুতে পড়াশোনার বিষয়টিকে
ভালোভাবে নিতেন না জানিয়ে তিনি বলেন, এক সময় তারা ভালো ভাবে নিত না, তবে এখন আর সেই সমস্যা নেই।
বেলায়েতের জন্ম ১৯৬৮ সালে; শ্রীপুরের কেওয়া পশ্চিম খণ্ড এলাকায়
স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। দৈনিক করতোয়া প্রত্রিকায় শ্রীপুর
প্রতিনিধি হিসেবে কাজের পাশাপাশি তিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি
নিচ্ছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বেলায়েত জানান, ২০১৭ সালে ঢাকার বাসাবোর
দারুল ইসলাম আলিম মাদরাসা থেকে ৪ দশমিক ৪৩ জিপিএ নিয়ে তিনি এসএসসি (ভোকেশনাল) পাস
করেন। এরপর ২০২১ সালে রামপুরার মহানগর কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জিপিএ ৪
দশমিক ৫৮ পেয়ে পাস করেন এইচএসসি (ভোকেশনাল)।
বন্ধুর পথে চলা
এই
বয়সে এসএসসি, এইচএসসি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কেন- সে প্রশ্ন উঠতেই
আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন বেলায়েত।
জানালেন,
১৯৮৩ সালে তখন তিনি সবে নবম শ্রেণিতে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা হাসান আলী।
চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতেই পরিবারের সবাই হিমশিম খাচ্ছিলেন।
তখন পড়ালেখা বন্ধ করে কাঁধে তুলে নেন পুরো সংসারের দায়িত্ব।
পরিবার
সামলাতে বেলায়েত ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে
কাজ শুরু করে মোটর গাড়ির ওয়ার্কশপে। দিনমজুর
ছাড়াও চা-বিক্রির কাজও করেছেন তিনি।
স্মৃতিচারণ করে বেলায়েত বললেন, “আগে অনেক অভাবের
মধ্যে ছিলাম। সংসারের আর্থিক দূরবস্থার কারণে ১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারি
নাই। বাবা অসুস্থ ছিল। ফরম ফিলাপের টাকা দিয়ে বাবার চিকিৎসা করেছি।
“১৯৮৮ সালে আবার দিতে গেলাম, তখন বন্যার কারণে পারি নাই। ১৯৯০ সালে
দিতে চাইলাম, তখন মা অসুস্থ। ফরম ফিলাপের টাকা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করালাম। তারপর
সংসার হল, আর পরীক্ষা দেওয়া হল না।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে নিজের ‘অপূর্ণতা’ তিনি
পূরণ করতে চেয়েছিলেন ভাই-বোনদের মাধ্যমে, পরবর্তীতে
সন্তানদের দিয়ে। কিন্তু তা পূরণ না হওয়ায় আক্ষেপ আছে তার।
বেলায়েত বলেন, “ছোট ভাইদের পড়াতে চাইলাম। চেয়েছিলাম ভাইয়েরা
প্রতিষ্ঠিত হলে আমিও প্রতিষ্ঠিত হব। কিন্তু এসএসসিতে ফেল করায় তা আর হয়নি।
“এরপর আমার ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইলাম। তাদের
পেছনে সময় দিলাম। বড় ছেলে এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গাজীপুর সদরে রোভার
পল্লী কলেজে অ্যাকাউন্টে পড়ে।”
ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে না পারলেও মেয়েকে পড়ানোর স্বপ্ন
দেখেন তিনি। তাকে ঢাকা রাজউক কলেজে ভর্তি করান। কিন্তু সেখানে মেয়ে পড়ালেখা চালিয়ে
যেতে পারেনি।
“মেয়েকে ঢাকায় রাজউক কলেজে ভর্তি করালাম। ভর্তি করানোর পরের দিন মেয়ে
সেখানে যেতে আপত্তি জানাল।
“পরে তাকে এলাকার একটা কলেজে ভর্তি করালাম। সেখান জিপিএ ৩ পেল। সেটা
নিয়ে তো আমি সন্তুষ্ট না। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে
অনার্সে ভর্তি হয়। দুই সেমিস্টার শেষে আর পড়ালেখা করল না।”
বেদনার সুরে বেলায়েত বললেন, “নিজে উচ্চশিক্ষিত
না হতে পারলেও সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন ছিল। মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়ায় নিজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার
স্বপ্ন নিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দিই।”
গেল বছর বেলায়েত যখন এইচএসসি পরীক্ষা দেন, তখন তার ছোট ছেলে এসএসসি
পরীক্ষা দেয়। সেই ছেলে বর্তমানে কলেজে পড়ে, আর তিনি এখন ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার্থী।
কর্মজীবন ও পড়ালেখা নিয়ে বেলায়েত বলেন, “সংসার পরিচালনা করেও যে
লেখাপড়া করা যায়, আমি সেটার চেষ্টা করেছি।
“বাবা মারা যাওয়ার পর আমি দৈনিক করতোয়ায় সংবাদ কর্মী হিসেবে কাজ
নিলাম। ছোটখাটো ব্যবসাও করতাম। ক্লাস নাইন পর্যন্ত একটা সার্টিফিকেট ছিল, ওটাও হারিয়ে
ফেলেছি। পরে চিন্তা করলাম, লেখাপড়াটা করতে থাকি।”
বাধা নেই পড়ালেখায়
বেলায়েতের ৫৫ বছর বয়সে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা কিংবা
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কোনো বাধা আছে কি না, সেই প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে
সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, কারিগরি
শিক্ষার ক্ষেত্রে যে কোনো বয়সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের উপ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক
(ভোকেশনাল) জাকারিয়া আব্বাসী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেসরকারি
প্রতিষ্ঠানে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বয়সের কোনো বাধা নেই। যে কেউ যে কোনো বয়সে
এসে কারিগরিতে ভর্তি হতে পারেন।”
বেলায়েতের পড়াশোনার আগ্রহ নিয়ে কথা হয় মহানগর কারিগরি
স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম উল্লাহ সেলিমের সঙ্গে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন,
“তিনি গত বছর ৪ দশমিক ৫৮ নিয়ে পাস করেছেন। এই বয়সেও তার পড়াশোনার প্রতি অনেক
আগ্রহ। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান। আমি আশা করি, উনি সেখানে পরীক্ষায় ভালো
ফলাফলের মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ পাবেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বয়স নিয়ে কোনো
বাধ্যবাধকতা নেই বলে নিশ্চিত করেছেন ঢাবি অনলাইন ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের
শর্তটা হল, সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস
করেছে কি না। উনি যে সালের কথা বলেছেন, নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবেন।
উনি যেহেতু পড়াশোনার মধ্যে আছেন এবং অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষার্থীরা যেভাবে এসএসসি ও
এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন করেন, উনি সেভাবেই আবেদন করেছেন।”
হাল
ছাড়বেন না
পড়াশোনা নিয়ে বেলায়েতের প্রবল আগ্রহের
বিষয়ে ছোট ছেলে সাদেক শেখ জীবন বললেন, “বাবা
যখন নবম শ্রেণিতে পড়েন, তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে। বাবা যখন এইচএসসি পাস করেন, তখন আমি এসএসসি। উভয় পরীক্ষায় আমার চেয়েও বাবার জিপিএ বেশি।
“বাবা সংসারের অন্যান্য কাজ করেও লেখাপড়া
করেন। আমরা রাতে যখন ঘুমিয়ে যাই। তিনি গভীর রাত জেগে লেখাপড়া করেন।”
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে
বেলায়েতের বর্তমান মানসিক অবস্থার কথা জানালেন সহধর্মিনী সখিনা
আক্তার।
“স্বামী আমার ঢাবি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনেক
টেনশনে আছেন। রাতে আমরা শুয়ে পড়লে- আমাদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তার জন্য তিনি বাড়ির সামনে থাকা তার
অফিস কক্ষে বসে গভীর রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।”
মা জয়গুন বিবি বলেন, “আমার এ ছেলে অনেক ধৈর্য্যশীল। আমি তাকে বিভিন্ন সময় উপদেশ দিতাম- বাবা জমি-জমা ভাগ হলেও লেখাপড়া ভাগ হয় না। ছোট বেলা থেকেই এ
কথাটাকে ও মনে প্রাণে নিয়েছিল। …আমি তার জন্য দোয়া করছি- যেন আল্লাহ ছেলের
ঢাবিতে ভর্তির ইচ্ছা পূরণ করেন।”
এ বয়সে আগের মত পড়াশোনা মুখস্থ হয় না জানিয়ে বেলায়েত হাল না ছাড়ার কথা জানালেন। মুখস্থ না হওয়ায় পড়ার পাশাপাশি তিনি প্রচুর লেখেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেলে পড়াশোনা
ছেড়ে দিবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে
বললেন,
“কখনোই না। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় আমার স্বপ্ন বটে, তবে পড়াশোনা
নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।”
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক
কাজী নাফিয়া রহমান ও বগুড়া প্রতিনিধি জিয়া শাহীন)