ঢাকার রাস্তায় গণপরিবহন হিসেবে যাত্রী পরিবহন করে- এমন বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা পাঁচ হাজারের মত; এর মাত্র ৬৬৭টি বিআরটিসির। শতকরা হিসেবে তা ১২ শতাংশের কম।
বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, ঢাকায় রাস্তা বাড়ানোর সুযোগ যেহেতু কম, সেহেতু যানজট কমাতে আর কর্মঘণ্টা বাঁচাতে বাড়াতে হবে বাস, বিশেষ করে দ্বিতল বাস, যাতে রাস্তার অল্প জায়গা ব্যবহার করে অনেক বেশি যাত্রী বহন করা যায়।
বিআরটিসির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, ঢাকার ৪৫টি রুটে চলাচলকারী ৬৬৭টি বাসের মধ্যে দোতলা যানের সংখ্যা ৪৪৫টি; বাকি ২২২টি একতলা বাস। অর্থাৎ ঢাকার প্রতিটি রুটে গড়ে তাদের বাসের সংখ্যা মাত্র ১৫টি।
এসব রুটের মধ্যে গুলিস্তান থেকে নরসিংদী, মেঘনা, গৌরীপুর; কুড়িল বিশ্বরোড থেকে ভুলতা, বিশনন্দী, ইটাখোলা; মতিঝিল থেকে গাজীপুর; গাবতলী থেকে গাজীপুর; চিটাগাং রোড থেকে সাভার এবং যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়ার মতো পথও রয়েছে।
আবার ঢাকায় বিআরটিসি বাসের বড় অংশই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া। ফলে চলতি পথের সাধারণ যাত্রীরা সেসব বাসের সুবিধা পান না।
বাড্ডার বাসিন্দা তায়েব হোসেন জানান, পেশার তাগিদে প্রতিদিন তাকে লালমাটিয়া যাতায়াত করতে হয়। কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মোহাম্মদপুরগামী বিআরটিসির দ্বিতল বাস ধরতে পারলে তার সুবিধা হয়। কিন্তু ওই রুটে বাসের সংখ্যা খুবই কম।
“বাস আসে আধাঘণ্টা, এক ঘণ্টা পর পর। এ কারণে দীর্ঘক্ষণ বাসের অপেক্ষায় থাকতে হয়।”
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ঢাকা মহানগর ও আশপাশের এলাকায় অনুমোদিত রুটের সংখ্যা ৩৮৬টি। এসব রুটে ১০ হাজার ২৭৯টি বাস-মিনিবাসের অনুমোদন আছে। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ৮১৬৯; বাকি ২১১০টি মিনিবাস।
তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি বলছে, ঢাকায় চলাচলকারী বেসরকারি বাস-মিনিবাসের সংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার। অনুমোদন থাকলেও অনেক রুটে বাস নামেনি। কিছু বাস মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
এর সঙ্গে বিআরটিসির বাস যোগ করা হলেও বাসের মোট সংখ্যা ছয় হাজারের কম থাকে। তাতে ঢাকায় মোট বাসের সংখ্যায় বিআরটিসির ভাগ থাকে ১২ শতাংশের কম।
ওই ১২ শতাংশ বাসের সবগুলো যে গণপরিবহন হিসেবে সেবা দেয় না, সে কথা তুলে ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ঢাকার রাস্তায় গণপরিবহন নেই। বিআরটিসির যে বাসগুলো আছে, তার অনেকটাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া। ফলে গণপরিবহন হিসেবে মানুষকে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়ে গেছে।
ফাইল ছবি
“সরকার বিআরটিসিকে যে উদ্দেশ্যে পরিচালিত করছিল, তা যথাযথভাবে উদ্দেশ্য পালন হচ্ছে না। সরকার যে উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করেছে, সেই উদ্দেশ্যও ব্যাহত হচ্ছে বাসগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়ার কারণে।”
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ মোবাশ্বের হোসেন বলেন, বিআরটিসির একটি বাস যখন কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাস হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, সেই বাসটি কর্মীদের আনা-নেওয়া ছাড়া বাকি সময়টা অলস পড়ে থাকছে।
“এগুলো রাস্তায় থাকলে মানুষ সেবা পেত। বিআরটিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান, তাদের আর্থিক লাভের কথা হিসাব না করে সার্বিক লাভের কথা হিসাব করতে হবে।”
‘সার্বিক লাভের’ ব্যাখায় তিনি বলেন, “ভালো বাস হলে অনেকেই প্রাইভেটকার এড়িয়ে চলবে। ১০ জন যাত্রী যদি প্রাইভেটকার রেখে বাসে চড়ে, তাহলে ওই ১০টি গাড়ির তেল পুড়বে না। অর্থনৈতিকভাবে দেশ লাভবান হবে।”
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. মো. সালেহ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে যত সুপারিশ এসেছে, তার সবকটিতেই বিআরটিসিকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে।
ফাইল ছবি
“বিআরটিসিকে আরও অনেক বেশি গাড়ি দেওয়া দরকার। তাতে শহরে ছোট গাড়ির আধিক্য কমবে। সিটি সার্ভিসে বাসের জন্য বেসরকারি পরিবহনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। সরকার যদি ঢাকার জন্য বিআরটিসির দুই থেকে আড়াই হাজার বাস দেয়, তাহলে এটা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।
“স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বহনেও তারা ভূমিকা রাখতে পারবে। অফিস-আদালতের ছোট গাড়ি কমিয়ে দিয়ে বিআরটিসি এসি বাস চালাতে পারে।”
দ্বিতল বাস বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে সালেহ উদ্দিন বলেন, “আমাদের শহরের জন্য দ্বিতল বাস খুব দরকার। আমাদের মানুষ অনেক, কিন্তু সড়ক কম। এজন্য কম জায়গায় অনেক যাত্রী পরিবহন করতে বিআরটিসির দ্বিতল বাস বাড়াতে হবে।”
৩০ শতাংশ বাসই ইজারায়
বিআরটিসি জানিয়েছে, ২০০০ সালের পর সারাদেশে তাদের বহরে ২২০৪টি বাস যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে বাস আছে এক হাজার ৬০০টি। এর মধ্যে সচল আছে ১ হাজার ২১৭টি; যার মধ্যে ৫০৯টি দ্বিতল বাস, বাকি ৭০৮টি একতলা।
ফাইল ছবি
রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে তাদের কাছে থাকা বাসগুলোর মধ্যে ২০১টি একতলা এবং ৭৩টি দ্বিতল বাস বড় ধরনের মেরামতের অপেক্ষায় রয়েছে। তিনটি একতলা বাস এবং একটি দ্বিতলবাস রয়েছে হালকা মেরামতের অপেক্ষায়। আর ১০৫টি বাস অকেজো ঘোষণা করতে হবে।
সারাদেশে এ সংস্থার ৩৫৫টি বাস বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ভাড়া দেওয়া; বাকি ৮৬২টি গণপরিবহন হিসেবে চলে। অর্থাৎ সারাদেশে চলাচলকারী মোট বাসের প্রায় ৩০ শতাংশই ইজারা দেওয়া। আবার ৫০৯টি দ্বিতল বাসের মধ্যে ২০৮টিই চলাচল করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য।
অন্যদিকে ঢাকায় চলাচলকারী বাসগুলোর প্রায় অর্ধেকই ভাড়া দেওয়া। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং শিক্ষার্থী পরিবহন করা হয় এসব বাহনে।
বিআরটিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. তাজুল ইসলাম জানান, সচিবালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই বেশি গাড়ি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন তারা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, তারাও আমাদের জনগণের একটা পার্ট। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে ক্লাসে পৌঁছানো, আমাদের স্টাফরাও কিন্তু বিআরটিসির সেবা পাওয়ার দাবিদার।”
ফাইল ছবি
এসব বাস অনেকটা সময় বসে থাকে, এমন অভিযোগের জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাড়া দেওয়া প্রতিটি গাড়ি দিনে কমপক্ষে তিনটা করে ট্রিপ দেয়। মাঝখানে গাড়িগুলো বিরতিতে থাকে।
“এটাকেই অনেকে মনে করেন, গাড়িগুলো অলস পড়ে আছে। আমরা ইদানিং একটা নির্দেশনা দিয়েছি- যেসব স্টাফ বাস সকালে আসবে, বিকালে যাবে- সেগুলো মাঝখানে ট্রিপ দেবে। আমরা গাড়ির সর্বোচ্চ ব্যবহারে বদ্ধপরিকর।”
বিআরটিসিকে কেন লাভের চিন্তা করতে হবে, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সেবার পাশাপাশি লাভও দেখতে হবে। লাভ না করলে আমি স্টাফদের বেতন দেব কোত্থেকে?”
তবে চাহিদার তুলনায় গাড়ির পরিমাণ যে কম, সে কথা স্বীকার করে তাজুল বলেন, বিআরটিসির গাড়ির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। এজন্য আরও গাড়ি আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
“কোরিয়া থেকে আমরা ৩২০টি গাড়ি আনার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি, আগামী এক বছরের মধ্যে বিআরটিসিতে আরও গাড়ি যুক্ত হবে। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর কমপক্ষে আড়াইশ গাড়ি মেরামত করে চলাচল উপযোগী করা হয়েছে।”
বিআরটিসির চেয়ারম্যান বলছেন, এবার কোরিয়া থেকে গাড়ির সঙ্গে ৩০ শতাংশ হারে স্পেয়ার পার্টস আনা হবে।
“আগে ১০ শতাংশ স্পেয়ার পার্টস আনা হত, যে কারণে গাড়ি বসে যেত মেরামতের অভাবে। ৩০ শতাংশ স্পেয়ার পার্টস আনলে গাড়ি অকেজো হয়ে যাবে না।”