ক্যাটাগরি

সুনামগঞ্জে বন্যা: সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে

ঢল ও
বর্ষণের এই পানি বর্ষার পাহাড়ি ঢলের জলাধার হিসেবে বিবেচিত হাওরে এসে নামছে।
তাছাড়া কালনী-কুশিয়ারা-ধনু হয়ে এই পানি ধিরে ধিরে মেঘনায় গিয়ে পড়ছে।

আগামী
২৪ ঘণ্টায় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে পানি বৃদ্ধির শঙ্কা নেই উল্লেখ করে সিলেট ও
সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির আশা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

সুনামগঞ্জ
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর বিভাগ-২) মো. শামসুদ্দোহা বিডিনিউজ
টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রোববার রাত ৯টায় জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমা
নদীর পানি প্রায় ১৮ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার নিচ দিয়ে বইছে। সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর
পানি ষোলঘর পয়েন্টে ৭.৬২ মিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হয়। গত দুদিন ধরে পানি দ্রুত
কমছে। তবে এই পানি সুরমা হয়ে ধনুতে গিয়ে পড়ছে। আরেকটি শাখা কালনী ও চামতি হয়ে
কুশিয়ারার মাধ্যমে মেঘনায় গিয়ে পড়ছে।  

বাংলাদেশ
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে তিনি জানান, আবহাওয়া
সংস্থা সমূহের পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী ২৪ ঘণ্টা (২৩ মে সকাল ৬টা পর্যন্ত) দেশের
উত্তর পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয়ের কিছু স্থানে মাঝারি থেকে ভারি
বৃষ্টিপাত হতে পারে। তবে সুরমা ও কুশিয়ারায় পানি বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নাই। তাই
আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।

এদিকে
সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নেমে যাওয়ায়
আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া মানুষজন বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। রাস্তাঘাট ভেসে ওঠায়
যাতায়াতও স্বাভাবিক হচ্ছে।

অনেকদিন
পর রোববার রোদের দেখা পেয়ে ভেজা বোরো ধান শুকাতে দেখা গেছে কৃষকদের। তবে তাদের
ভেজা ধানে অঙ্কুর গজিয়ে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত
কৃষকরা জানিয়েছেন, গত বুধবার রাতেই কাটার উপযুক্ত প্রায় ৫ হাজার হেক্টর বোরো ধান
তলিয়ে গেছে কৃষকের। কিন্তু সরকারি হিসাবে মাত্র ১ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান ডুবে
গেছে বলে স্বীকার করা হয়েছে।

সুনামগঞ্জ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, “বারোদিন হলো সুনামগঞ্জে
পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণ ছিল। তবে এক সপ্তাহ আগে আমাদের হাওরের বাইরের প্রায় ১ হাজার
হেক্টর জমির পাকা বোরো ধান তলিয়েছে। বোরো ক্ষেত থেকে পানি দ্রুত নামার সম্ভাবনা
নেই। তাই কৃষক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আমাদের হিসাবে বোরো ধান ছাড়াও আউশ ধানের ৭৯
হেক্টর বীজতলা, ২০ হেক্টর আউশ ধান, ৭০ হেক্টর সব্জি ও ৭৫ হেক্টর চিনা বাদাম তলিয়ে
গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এই চাষিদের তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাদের
প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হবে।

জেলা
মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মণ্ডল বলেন, গত ১০ মে থেকে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণ শুরু হয়েছিল।
১৩ মে থেকে পানি বাড়তে থাকে। এরপর সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় বন্যায় ভেসে গেছে ১ হাজার ৩১০ পুকুরের সাড়ে তিন কোটি টাকার
মাছ।

এই
ক্ষয়-ক্ষতি প্রাথমিক পর্যায়ের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্ষয়-ক্ষতি আরও বাড়তে পারে।
ইতোমধ্যে ৫টি উপজেলায় ১ হাজার ১৪৭ জন খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের আর্থিক
ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন
ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার মৎস্য খামারিরা। তাছাড়া সুনামগঞ্জ সদর ও শান্তিগঞ্জ
উপজেলার খামারিরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪টি উপজেলার ১৭৪ হেক্টর আয়তনের পুকুরের মাছ
পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় প্লবিত হয়ে, বাঁধ ভেঙে মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ১৬৮ টন মাছ ও
৫০ টন পোনা ভেসে গেছে। এছাড়াও অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে খামারিদের। যার আর্থিক
মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।

ক্ষতিগ্রস্ত
মৎস্য খামারি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইবরাহিমপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, “আমার
তিনটি পুকুরের ৫ লক্ষ টাকার মাছ ভেসে গেছে। আমি পুকুর ভাড়া করে ঋণ নিয়ে মাছ চাষ
করেছিলাম। একদিনের মধ্যেই পুকুরের মাছ ভাসিয়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। এখন কীভাবে
ঋণ পরিশোধ করব এই চিন্তায় অস্থির আছি।”

সুনামগঞ্জ
জেলা মৎস্য অফিস থেকে জানা গেছে, গত ১২ দিনের বন্যায় সুনামগঞ্জের ৪টি উপজেলার
খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ছাতক দোয়ারাবাজার
উপজেলার খামারিরা। তাছাড়া সুনামগঞ্জ সদর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার খামারিরাও
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪টি উপজেলার ১৭৪ হেক্টর আয়তনের খামার পাহাড়ি ঢল ও বন্যায়
প্লবিত হয়ে, বাঁধ ভেঙে মাছ ভেসে গেছে। এতে প্রায় ১৬৮ টন মাছ ও ৫০ টন পোনা ভেসে
গেছে। এছাড়াও অবকাঠামোগত ক্ষতিও হয়েছে খামারিদের।

সুনামগঞ্জ
সদর উপজেলার ইবরাহিমপুরের খামারি মুসলিম উদ্দিন বলেন, “আমার ৯টি পুকুরের মাছ ভেসে
গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকার মতো। এখন কীভাবে এই ক্ষতি সামাল দিব এই
চিন্তায় অস্তির আছি। আমাদের বিশেষ বিবেচনায় ও সহজ শর্তে ঋণ দিলে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে
পারব।”

একই
গ্রামের খামারি মিজানুর রহমান বলেন, “আমার চারটি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষতি
হয়েছে প্রায় ৮ লাখ টাকার মতো। এই টাকা ঋণ নিয়ে মাছ চাষ করেছিলাম। মাছ ভেসে যাওয়ায়
এবং নতুন করে পূজি না থাকায় খামার এখন বন্ধের পথে।”

হাসননগরের
খামারি রফিকুল ইসলাম কালা বলেন, “আমি ক্ষুদ্র খামারি। আমার তিনটি পুকুরের মাছ ভেসে
গেছে। মৎস্য বিভাগের কেউ খোঁজ নেয়নি। কখনও কোনো ক্ষতিপূরণও পাইনি। আমি এনজিও থেকে
ঋণ এনে পুকুর ভারা করে চাষ করেছিলাম। এখন পথে বসে গেছি।”

জেলা
মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মণ্ডল বলেন, “বন্যায় আমাদের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার মাছ,
পোনাসহ অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার সংশ্লিষ্টদের দিয়ে প্রাথমিক
ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করেছি। এই তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হবে।”