ক্যাটাগরি

সেতুর পাশে চর; সরু হচ্ছে কর্ণফুলী, কমছে গভীরতা

বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, নদীতে পিলার দিয়ে সেতু নির্মাণ, ক্রমাগত পলিথিনসহ আবর্জনা ফেলা এবং নদীর গতি-প্রকৃতির কারণে উত্তর পাড়ে পলি জমে চরের সৃষ্টি হচ্ছে।

নিয়মিত ড্রেজিং করে চর অপসারণ এবং দখল মুক্ত করা না হলে দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলী তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারাবে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

উত্তরে চর, দক্ষিণে গভীর

শাহ আমানত সেতুর ‍উত্তর পাড়ে রোববার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে লং বুম স্কেভেটর দিয়ে মাটি তোলার কাছ চলছে।

সেতুর ১ নম্বর পিলারের তীর ঘেঁষে মাটি তুলে পাড়ে রাখা হচ্ছে। এর পাশেই নদীতে জেগে ওঠা চর। সেই চর পেরিয়ে নৌকায় উঠছেন যাত্রীরা।

এখানে কথা হয় মাটি উত্তোলনের ড্রেজারের শ্রমিক মোহাম্মদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হাত দিয়ে সেতুর ২ নম্বর পিলার দেখিয়ে বলেন, “ভাটার সময় ওই পর্যন্ত হাঁটি যেতি পারবেন। এখানে সব মাটি। জোয়ারের সময় একটু পানি দেখা যায়।”

বছর খানেক ধরে নদীর মাটি তোলার কাজ করছেন লং বুম স্কেভেটরের চালক বেলাল হোসেন। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই খান (২ ও ৩ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি) পর্যন্ত মাটি ছিল।

“ড্রেজারে তুলে পাড়ের কাছে আনে। তারপর আমরা কেটে উপরে তুলি। ওই পাশেও (সেতুর পশ্চিম পাশে) কিছুদিন মাটি তুলেছি। এখন এদিকের কাজ চলছে। কাটার পর জোয়ারে আবার কিছু মাটি জমে যায় নদীতে।”

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামের একটি সংগঠন গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশের গভীরতা ও দখল জরিপ ২০২২’ নামের একটি সমীক্ষা চালায়।

রোববার প্রকাশিত এই জরিপের প্রতিবেদন অনুসারে, সেতুর উত্তর পাশে নদীর ২ নম্বর পিলারের কাছে গভীরতা মাত্র ৭ দশমিক ৭ ফুট। আর দক্ষিণ পাড়ে ৫ নম্বর পিলারের কাছে ৭৮ ফুট।

এর ৫০০ মিটার উজানে চাক্তাই ও রাজখালী খালের সংযোগ স্থলে নদীর গভীরতা জরিপে কোনো কোনো অংশে মিলেছে মাত্র ২ থেকে ৪ ফুট। অথচ এ অংশের বিপরীত দিকে নদীর দক্ষিণ তীরে তা ৪৮ ফুট।

চাক্তাই খালের মুখে একাংশজুড়ে জেগে ওঠা চর জোয়ারের সময়ও দেখা যায়। তাই তুলনামূলক গভীর অংশ দিয়েই চলাচল করছিল নৌযান।

নৌকার মাঝি আবদুল হক বলেন, “জোয়ারের সময় চরের উল্টা পাশ দিয়ে খালে ঢুকতে হয়। আর ভাটার সময় সেদিকেও খুব আস্তে আস্তে খালের মুখ দিয়ে ঢুকতে হয়।”

তবে চাক্তাই খালের মুখ থেকে নদীর আরও ৫০০ মিটার উজানে ফিরিঙ্গি বাজার অংশে উত্তর পাড়ে ২৪ ফুট এবং দক্ষিণ তীরে ২৫ ফুট গভীরতা মিলেছে জরিপে।

জরিপ প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার পালিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উত্তর পাড়ে চর পড়ে ও বর্জ্য জমা হয়ে নদী প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। এখন এ অংশে পানির প্রবাহ খুব কম। এমনকি নৌযান চলাচলও কমে গেছে।

“বিপরীতে সেতুর দক্ষিণ অংশে গভীরতা ও পানির প্রবাহ বেশি। সংলগ্ন কর্ণফুলী খাল ও শিকলবাহা খালের প্রবাহও আছে। একারণে দক্ষিণের পিলারের নিচের কিছু মাটি সরে গেছে। এতে পিলারের কংক্রিটের স্ট্রেংথ কমবে না। কিন্তু দুর্বল হয়ে পিলার স্যাটেল (নিচের দিকে নেমে যাওয়া) হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা আছে।”

তিনি বলেন, “নদী নিয়মিত ড্রেজিং না হওয়ায় চর পড়ছে। অবৈধ দখলদাররা নানা স্থাপনা নির্মাণ করে নদীর অংশও ভরাট করে ফেলেছে। আরএস বা পিএস ধরে মাপলে দেখা যাবে নদীর উত্তর পাড় কীভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে।”

৩৫ বছরে প্রস্থ কমে অর্ধেক

কর্ণফুলী নদীর দখল উচ্ছেদ বিষয়ে উচ্চ আদালতে চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নদীর ২৫টি গুগল টাইমল্যাপস ম্যাপ তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করে।

তাতে দেখা যায়, ১৯৮৫ সালে নদীর দুই তীরের (শাহ আমানত সেতুর কাছে) দূরত্ব ছিল ৯৫২ মিটার। ২০০৫ সালে তা কমে হয় ৭৯৩ মিটার। ২০১৩ সালে ৫৮৬ মিটার। এবং সব শেষ ২০২১ সালে তা কমে হয় ৪৪৬ মিটার।

 

কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখন যেখানে মেরিনার্স রোড, সেখানে ছিল নদীর তীর। নদীর জমিতেই এই সড়ক ও ওয়াকওয়ে করা হয়েছে। নদীতে চর পড়েছে। সেই চর আবার দখল করে বসতিসহ নানা স্থাপনা হয়েছে। ৯০০ মিটারের বেশি প্রশস্ততার নদী এখন ৫০০ মিটারেরও কম।

তিনি বলেন, “কর্ণফুলী হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। নদীতে ড্রেজিং এ একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এর একটাও নদীর স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে হচ্ছে না। নদীর ভূগোল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন অংশে ডুবো চর আছে। নদীর পানি ধারণ ক্ষমতাও কমছে। এতে স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। যার সুদূর প্রসারী প্রভাব আছে।”

“এই অবস্থা চলতে থাকলে উজানে এর প্রভাব পড়বে। সেখানে বন্দরের মূল চ্যানেল, যা দেশের লাইফ লাইন। তাই এখনই সতর্ক হতে হবে,” বলেন ইদ্রিস আলী।

ড্রেজিং শেষ জুনে

বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলনে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

৩ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া অংশে ড্রেজিং এর এই প্রকল্পে শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ২৫০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের শুরুতে মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত।

সম্প্রতি মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে হয়েছে ২৯৭ কোটি টাকা।

এরআগে ২০১১ সালে কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং এ ২২৯ কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সে কাজ ফেলে চলে যাওয়ায় ২০১৪ সালে চুক্তি বাতিল করে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

চলমান প্রকল্পটির পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ হাইডোগ্রাফার কমান্ডার এম আরিফুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা জুনের মধ্যে ড্রেজিং এর কাজ শেষ করব। এরপর নিয়মিত মেনটেইনেন্স চলবে।”

চর পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “চাক্তাই ও রাজখালী খাল হয়ে আসা পলিথিনসহ যাবতীয় আবর্জনা নদীতে পড়ছে। ময়লা ঘিরে মাটি জমে চর হয়। আর পিলার সেতুর কিছুটা প্রভাব তো আছেই। পলিথিন ও আবর্জনা পড়া বন্ধ করতে হবে।”

নদীর সেতু সংলগ্ন উত্তর পাড়ে গভীরতা কমার বিষয়ে জানতে চাইলে কমান্ডার আরিফুর বলেন, “আমরা গত ৫০ বছরে নদীর গতিপ্রবাহ দেখেছি। কর্ণফুলী এ অংশে উত্তর পাড়ে গড়ে বেশি, আর দক্ষিণে ভাঙে। এটাই এ নদীর প্রবণতা।”

কর্ণফুলী তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ বিষয়ে যে রিটটি ছিল সে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আদালত বিভাগীয় কমিশনারকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে কয়েকবার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে শুনানি হয়েছে। তিনি আদেশ দিলেই আমরা উচ্ছেদে যাব।”