ক্যাটাগরি

একটি অমর গানের গল্প

কিন্তু তার আগে এই লেখামালার মূল শিরোনাম ‘শিল্পের সিন্দুক’ বিষয়ে দুটো কথা বলে নিতে চাই। তোমরা যারা গ্রামে কিংবা মফস্বলে থাকো, তারা হয়তো কেউ কেউ এই ‘সিন্দুক’ নামক বিশাল লোহা কিংবা কাঠের প্যাটরাজাতীয় বস্তুটি দেখে থাকতে পারো। এর মধ্যে সযত্নে সংরক্ষিত থাকে পরিবারের যত মূল্যবান, প্রিয় ও পুরোনো ঐশ্বর্য আর স্মৃতিময় সামগ্রী।

ঠিক সেরকমই একটি গোপন সিন্দুকের সন্ধান রয়েছে আমার কাছে, যেখানে থরে থরে সাজানো আছে পৃথিবীর তাবৎ শিল্পের- সংগীত, সাহিত্য, চিত্রকলা, আলোকচিত্র, সিনেমা ইত্যাদির অমর সব নিদর্শনের সংগ্রহ। সেখান থেকেই সময়ে সময়ে একটি করে লুকোনো রত্ন বার করে এনে আমি তোমাদের শোনাব তার আঁতুড়কথন, তার হয়ে-ওঠার গল্প।

তো, এই সিরিজেরই প্রথম লেখাটি লিখছি আমাদের মহান ভাষা শহীদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করে, যে দিনটি এখন বিশ্বময় পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই দিনটির সঙ্গে একটি বিশেষ গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

আজ তোমাদের সেই বিখ্যাত ও অমর গানটির হয়ে-ওঠার গল্প শোনাব। তোমরা অনেকেই হয়তো জানো, এই গানটির রচয়িতা একজন ডাকসাঁইটে সাংবাদিক, বিলেতপ্রবাসী আবদুল গাফফার চৌধুরী, যিনি সদ্য শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন ৮৮ বছর বয়সে। কিন্তু যখন এই গানটি লেখা হয়েছিল তখন তিনি ছিলেন নেহাতই এক তরুণ, ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র!

সেটি ১৯৫২ সালের কথা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তখন সারা দেশ জুড়ে চলছিল উত্তাল আন্দোলন। তারই এক চরম মুহূর্তে ২১ ফেব্রুয়ারির সকালবেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করলে তাতে গুলি চালায় পুলিশ। এতে সালাম, শফিউর, রফিক, জব্বার প্রমুখ কজন অসম সাহসী তরুণ তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারায়, যাদের নাম আজ  সারাদেশ শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করে। তো এদেরই একজন, রফিককে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বারান্দায় এনে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। মৃত্যুপথযাত্রী রফিকের রক্তাক্ত মুখখানি দেখেই সেই মিছিলের সহযাত্রী আবদুল গাফফার চৌধুরী অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন সেদিন।

এটিকে তিনি কবিতা হিসেবেই লিখেছিলেন। পরে গণসংগীত শিল্পী আব্দুল লতিফ তাতে সুর আরোপ করেন। তবে আজ আমরা সবাই একুশের সকালে প্রভাতফেরিতে যে সুরে গানটি গাই সেই সুর কিন্তু সৃষ্টি করেছিলেন আরেকজন মেধাবী সুরকার, তার নাম আলতাফ মাহমুদ। এই সুরটি তিনি করেছিলেন ১৯৬৯ সালের দিকে। দুঃখের বিষয়, ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে। এই গানটির সঙ্গে আরও একজন মহান মানুষের নামও কিন্তু জড়িয়ে আছে একেবারে আষ্ঠেপৃষ্ঠে। তিনি আমাদের আধুনিক চলচ্চিত্রের জনক, জহির রায়হান, যিনি ১৯৭১ এর ঠিক পরপরই দেশে ফিরে তার নিখোঁজ বড় ভাই প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিজেও হারিয়ে যান চিরতরে।

সত্যি বলতে কি, তিনিই প্রথম তার কালজয়ী ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে আলতাফ মাহমুদের সুর করা এই গানটির সার্থক প্রয়োগ করেন। সেই ছবিতেই প্রথম দেখা যায়, শহীদ মিনারের পাদদেশে প্রভাতফেরিতে নগ্নপদে শতশত মানুষ আবেগভরে এই গানটি গাইছে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই গানটি ঠিক এভাবেই, এই সুরেই বিশ্বব্যাপী সহস্রকণ্ঠে গীত হয়ে চলেছে সমান আবেগে ও শ্রদ্ধায়।

বস্তুত, পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম গান খুবই দুর্লভ, যার সঙ্গে একটি জাতি তার জন্মনাড়ির সূত্রে বাঁধা পড়ে আছে। এই একটি গানের শক্তিতেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বেগবান হয়ে, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেয়- যার ফসল আমাদের এই স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর এই একটি গানের সূত্রেই অমর হয়ে আছেন আমাদের শিল্পভুবনের তিন দিকপাল- সাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, সংগীতপরিচালক আলতাফ মাহমুদ আর চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান।

চলো বন্ধুরা, আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই তিন মহান শিল্পীকেই জানাই আমাদের আনত অভিবাদন! বিশেষভাবে, গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি এই গানটির অমর স্রষ্টা সাংবাদিক, সাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরীকে।

কিডজ পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!