১২ বছর পর পরিবার পেল সুমনের খোঁজ।
এরপর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এল তদন্তে; তিন বছর খুঁজে তারা পেল পরিবারের কাছে হারিয়ে যাওয়া সেই সুমনের হদিস; ততদিনে তিনি ২৯ বছর বয়সী যুবক, বিয়ে করেছেন, সংসারও পাতিয়েছেন।
সুমনকে খুঁজে বের করার পর মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে তার হারিয়ে যাওয়া, পালিয়ে থাকার বিত্তান্ত তুলে ধরেন পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের বিশেষ সুপার জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি জানান, পল্লবীর গাড়িচালক বাবার ছেলে সুমন ২০১০ সালে জুয়া খেলে মোবাইল হারিয়ে ভয়ে আর বাড়ি ফেরেননি। এরপর ১২ বছর বিভিন্ন দোকানে কাজ করে এখন তিনি রিকশা চালাচ্ছিলেন।
২০১০ সালে অক্টোবর মাসে মোজাফফর হোসেন পল্লবী থানায় তার কিশোর সন্তান সুমনকে অপহরণ করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলা করেন।
সুমন তখন বাড়িতে থেকে একটি প্যাকেজিং কারখানায় কাজ করতেন। মিরপুরের শহীদ স্মৃতি স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
অপহরণের সেই মামলা প্রথমে পল্লবী থানা পুলিশ তদন্ত করে সুমনের হদিস বের করতে পারেনি। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) নামে তদন্তে, তারাও কিছু পায়নি। তখন তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। কিন্তু তারাও কূল-কিনারা পায়নি।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সুমন অন্তর্ধানের তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।
জাহাঙ্গীর বলেন, “আমরা প্রায় ১৯ মাস তদন্তে সুমনের কোনো সন্ধান না পেলেও আত্মগোপনে চলে যাওয়ার ১১ দিন পর সে তার বাবাকে যে নম্বর থেকে ফোন দিয়েছিল, তার সূত্র ধরে এগিয়ে যাই।”
কিন্তু সেখানেও কোনো ‘ক্লু’ মেলেনি। কারণ ওই নম্বরটি ছিল শাহবাগের একটি দোকানের, যেখান থেকে যে কেউ টাকা দিয়ে ফোন করতে পারেন।
এরপর গত মার্চ মাসে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও আশা ছাড়েননি পিবিআই কর্মকর্তারা। তারা খোঁজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
শাহবাগে সুমনের অবস্থানের সূত্র ধরে এভাবে নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করতে করতে কদমতলীতে সুমনকে পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর।
“আমরা সুমনের অবস্থান শনাক্ত করার পর ২৩ মে আদালতে মামলাটি পূনরুজ্জীবিত করার আবেদন করি। আদালত মঞ্জুর করার পর ওই দিনই তাকে কদমতলী থেকে উদ্ধার করি। ১২ বছর পর জানা গেল সুমন অপহরণ হয়নি।”
জুয়ার ফেরে অন্তর্ধানের পর যে জীবনে
পিবিআই কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর বলেন, ২০১০ সালের ৩১ অগাস্ট বাসা থেকে কর্মস্থলের উদ্দেশ্য বেরিয়ে মিরপুর-১১ নম্বর বাজার এলাকার চার রাস্তার মোড়ে তিন তাসের জুয়া খেলে ১০০ টাকা হেরে যান সুমন।
“তার কাছে অত টাকা না থাকায় জুয়াড়িরা জোর করে তার মোবাইল ফোন রেখে দেয়। মোবাইল ফোন জুয়ারীরা নিয়ে নেওয়ায় বাসার লোকজন মারধর করবে এ কারণে বাসায় আর সে ফিরে যায়নি।”
সেদিন মিরপুর থেকে গুলিস্থানে চলে গিয়েছিলেন সুমন। গুলিস্থানে ঘোরাফেরা করার পর রাতে বায়তুল মোকাররম মসজিদে গিয়ে শুয়ে পড়েন।
সেখান থেকে এক ব্যক্তি তাকে শাহবাগ ফুল মার্কেটে নিয়ে নাস্তা খাওয়ায় বলে সুমন জানিয়েছেন। সেখানে টিপু নামে এক ব্যক্তি তাকে শাহবাগ এলাকার একটি হোটেলে থাকা ও খাওয়ার শর্তে কাজ দেন।
ওই হোটেলের বাবুর্চি হারুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় সুমনের। হারুনের ভোলার লালমোহনের বাড়িতেও গিয়ে থেকে এসেছিলেন সুমন।
এরপর শাহবাগ এলাকায় বিভিন্ন চটপটির দোকান, পাফড কর্নের দোকান, একুরিয়ামের দোকানে কাজ করেন সুমন। কিছু দিন বাসের হেলপার হিসেবেও কাজ করেন।
নান্নু নামে এক গাড়িচালকের মাধ্যমে সুমন পরিবহনকর্মী হিসেবে কাজ করেন বলে জানান সুমন। এই সময়ই একটি মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়, তার সূত্র ধরে ওই মেয়ের বাসায়ও তার যাতায়াত শুরু হয়।
পিবিআই কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর বলেন, “এক পর্যায়ে ওই মেয়ের মার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে ওই নারীর স্বামী তালাক দেন। এর পরপরই প্রায় ৩ বছর আগে সুমন ওই নারীকে বিয়ে করেন।”
এরপর এই বছরই একটি পুত্রসন্তানের বাবা হন সুমন, তার বয়স এখন ৩ মাস। বাসা নেন কদমতলীতে।
পিবিআই পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুমনের নিজস্ব সংসার হয়েছে।
“আজ তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে সে বলেছে যে তাকে কেউ অপহরণ করেনি। পরে আদালত তাকে তার বাবার জিম্মায় মুক্তি দেন।”
সংবাদ সময়ে উপস্থিত থাকা সুমনের বাবা মোজাফফর হোসেন ১২ বছর পর সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে ছিলেন উৎফুল্ল।
“যাকে সুমন বিয়ে করেছে, তাকে নিয়ে সংসার করলে আমার কোনো আপত্তি নাই,” বলেন তিনি।
আদালত হয়ে সুমন পল্লবী এলাকায় তার বাবা-মার বাড়িতেই উঠেছে বলে পিবিআই কর্মকর্তারা জানান।