যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বের প্রধান সার রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া (রপ্তানি বাজারের ১৫ শতাংশ) পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ায় আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে; যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের সার আমদানিতেও।
রাশিয়া বাংলাদেশের সারের অন্যতম যোগানদাতাও। দেশে প্রতিবছর সাড়ে সাত লাখ টনের মত মিউরেট অব পটাশ বা এমওপি সারের প্রয়োজন হয়; এর তিন লাখ টন সারই আসে দেশটি থেকে। এছাড়া টিএসপি ও ডিএপি সারও আমদানি করা হয় সেখান থেকে।
এমন প্রেক্ষাপটে চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে উৎপাদিত হওয়ায় চাষাবাদে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ইউরিয়া নিয়ে আশঙ্কার তেমন কিছু না থাকলেও অন্য তিন প্রধান সার টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের সরবরাহ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে সরকারি নীতি নির্ধারকদের। কেননা যুদ্ধের কারণে সরবরাহ লাইন আর আগের মত নেই।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার বাজার বন্ধ হওয়ায় সার নিয়ে একটা অনিশ্চিয়তা তৈরি হলেও বিকল্প বাজার হিসাবে কানাডা থেকে সেই সার আমদানি করে আগামী বছরের চাহিদা পূরণ করবেন তারা। অন্যান্য উৎস থেকেও সার এনে সরবরাহ লাইন ঠিক রাখতে কাজ করছেন তারা। এক্ষেত্রে উচ্চমূল্যের বিষয়টি ভাবাচ্ছে তাদের।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বেড়ে যাওয়ার এই পরিস্থিতিতে দেশে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বাড়লেও আপাতত সারের দাম বাড়ানোর কোনো চিন্তা সরকারের নেই বলে তারা জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও আগামী অর্থবছরেও একই দামে সার বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সম্প্রতি তিনি বলেন, আগামী মৌসুমে আমরা চেষ্টা করবো দাম না বাড়াতে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবুও আমরা চেষ্টা করছি- দাম অপরিবর্তিত রেখে পরিকল্পনা অনুযায়ী সরবরাহ ব্যবস্থা সাজাতে।
রাশিয়ার বিকল্প হবে কানাডা?
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত (অতিরিক্ত সচিব) বলাই কৃষ্ণ হাজরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাশিয়া ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে এমওপি সার আমদানি একটুখানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও যুদ্ধ শুরুর আগেই রাশিয়ার বিকল্প হিসাবে কানাডাকে বেছে নিয়েছে সরকার।
তিনি জানান, প্রতিবছর দেশে এমওপি সারের চাহিদা সাড়ে সাত লাখ টন। এরমধ্যে তিন লাখ টন রাশিয়া থেকে এবং দেড় লাখ টন কানাডা থেকে আমদানি করা হত।
ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর আগেই রাশিয়ার বিকল্প হিসাবে কানাডার সঙ্গে সার আমদানির সমঝোতা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কানাডার রাষ্ট্রদূত সার রপ্তানির বিষয়ে সরকারকে আশ্বস্ত করেছেন। আগামী বছর কানাডা থেকে মোট সাড়ে পাঁচ লাখ টন এমওপি সার আমদানি করা হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, চলতি অর্থবছরের জন্য প্রয়োজনীয় সার মজুদ রয়েছে। চাহিদা ও সরবরাহে এখন পর্যন্ত সমস্যা নেই।
আর আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশে ৫৭ লাখ টন রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হবে প্রাক্কলন করে সংগ্রহের চেষ্টা শুরু হয়েছে।
মোট সারের মধ্যে ২৬ লাখ মেট্রিক টন ইউরিয়া, সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন টিএসপি, সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন এমওপি এবং সাড়ে ১৬ লাখ মেট্রিক টন ডিএপি সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বার্ষিক এ চাহিদার মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিসিআইসির ছয়টি সার কারখানা থেকে ১০ লাখ টন ইউরিয়া সারের যোগান আসবে।
ইউরিয়াসহ চাহিদার বাকি সার রাশিয়া, সৌদি আরব, চীন, মরক্কো, কানাডা, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার উৎস বন্ধ হলে টিএসপির জন্য বিকল্প হিসেবে কানাডার কথাই বেশি ভাবা হচ্ছে। সার রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশ থেকেও টিএসপিসহ অন্য সব সার আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বাড়তি দামে মরক্কো থেকে কিনতে হচ্ছে ৪০ হাজার টন সার
‘সাশ্রয়ী মূল্যে’ সোয়া লাখ টন সার কিনছে সরকার
যুদ্ধের বাজারে সার সরবরাহ অব্যাহত রাখতে কানাডাকে অনুরোধ
সার উৎপাদন ও মজুদের সঠিক হিসাব রাখার নির্দেশ
তিন সারের অতিমূল্যে বিপাকে কৃষক
হাতে আছে কত?
সার বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ১৯ মে এর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি গুদাম ও সরবরাহের জন্য পরিবহন ব্যবস্থায় ২ দুই ৩৬ হাজার ৫৫৭ টন টিএসপি, ২ লাখ ৬২ হাজার ৯২৭ টন এমওপি এবং ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮৫৩ টন ডিএপি সারের মজুদ রয়েছে। এতে করে মোট ৮ লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৮ হাজার টন নন ইউরিয়া সারের মজুদ রয়েছে।
আর বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) গুদামগুলোতে মজুদ আছে ছয় লাখ টন ইউরিয়া সার।
বিএডিসি চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত মোট ১৫ লাখ ৬২ হাজার টন নন ইউরিয়া সার বিতরণ করেছে। এর মধ্যে শুধু মে মাসে বিতরণ করা হবে ২৪ হাজার টন সার। এপ্রিলে বিতরণ বা বিক্রি করা হয়েছিল ২৫ হাজার ৭৯৭ টন সার। আগের অর্থবছরের (২০২০-২০২১) এপ্রিলে ৫৫ হাজার ২৬১ টন নন ইউরিয়া এবং মে মাসে ৪৯ হাজার ৯৮৭ টন সার বিতরণ করা হয় বলে বিএডিসির তথ্য বলছে।
কোন মওসুমে চাহিদা কত?
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, সারের বার্ষিক চাহিদার ৪০ শতাংশ প্রয়োজন হয় রবি মৌসুমের জন্য (কার্তিক থেকে ফাল্গুন)। আর খরিপ ১ (চৈত্র থেকে আষাঢ়) ও খরিপ ২ (শ্রাবণ থেকে আশ্বিন) মৌসুমের জন্য প্রয়োজন হয় অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ সার।
দেশে সাধারণত টিএসপি, ডিএপি ও এমওপির মত নন-ইউরিয়া সারগুলো শুকনো মৌসুমে ফসলের মাঠ প্রস্তুতের সময় ব্যবহৃত হয়। আর ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয় ফসলের বাড়ন্ত সময়ে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলাই কৃষ্ণ বলেন, সারের বার্ষিক চাহিদা অনুযায়ী মাসভিত্তিক বরাদ্দ ঠিক করা হয়। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই চার মাসে সবচেয়ে বেশি সার বিতরণ করা হয়। এর চার মাসে প্রায় ২৩ লাখ টন সার বিতরণ করা হয়। বাকি সময়গুলোতে প্রতিমাসে গড়ে ৪ লাখ ২৭ হাজার টন সার বিতরণ করা হয়।
সারের আমদানিকারক ও ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) নির্বাহী সচিব রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ জানান, তালিকাভূক্ত ডিলাররা নির্ধারিত মোকাম থেকে তাদের বরাদ্দ উত্তোলন করে থাকেন।
এছাড়া কোনো এলাকায় বিশেষ কারণে বাড়তি চাহিদার প্রয়োজন হলে ডিলার ও সংগঠনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালযের সুপারিশের আলোকে মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি বরাদ্দ দিয়ে ওই এলাকায় অতিরিক্ত সার বরাদ্দ দেওয়া হয়। পুরো কাজটি বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করা হয় বলে জানান তিনি।
সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে থাকা চারটি প্রধান রাসায়নিক সার ছাড়াও বেসরকারি উদ্যোগে বেশ কয়েক প্রকার সার দেশে আমদানি ও বিপণন হয়ে থাকে।
ভালো ফলনের জন্য কৃষি কর্মকর্তাদের পরমার্শে এসব ‘পুষ্টি সার’ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। বেসরকারিভাবে আনা এসব সারের মধ্যে রয়েছে এসওপি, জিপসাম, জিংক সালফেট মনো- হাইড্রেট, জিংক সালফেট হেপ্টা হাইড্রেট, বরিক অ্যাসিড, সলুবোর, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও অ্যামোনিয়াম সালফেট।
বিএফএ এর নির্বাহী সচিব জানান, দেশে বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর পাঁচ লাখ টন পুষ্টি সার আমদানি করা হয়। এবার ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকদের হয়তো এসব সার আগের চেয়ে চড়া দামে কিনতে হতে পারে।
বিভিন্ন সময় সারের সংকট প্রসঙ্গে অতিরিক্ত সচিব বলাই কৃষ্ণ বলেন, সারের যে সংকটের কথা শোনা যায় তা মজুদের কারণে কখনও হয় না। পণ্য পরিবহনে অনেক সময় জটের সৃষ্টি হয়। সেকারণে কয়েকদিনের জন্য কোথাও কোথাও সার সংকট দেখা দিতে পারে। আবার কোনো এলাকার কৃষক যদি হঠাৎ করে বেশি সার কিনে ফেলে বা কিনতে হয়, তাহলেও ওই এলাকায় ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তবে যেহেতু মাসে মাসে বরাদ্দের অনুকূলে সরবরাহ করা হয় তাই এখানে লম্বা সময়ের সংকট সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ নেই।
অব্যাহত থাকবে ভর্তুকি?
দেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো ও খাদ্য চাহিদা পূরণে প্রতিবছরই নির্ধারিত চারটি রাসায়নিক সারে ভর্তুকি দিয়ে আসছে সরকার। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম উঠানামা করলেও গত এক দশক ধরে দেশের বাজারে সারের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকি কমে দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে অনেকে শঙ্কা করছেন।
যদিও এখন পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে ভুর্তকি কমানোর বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী একাধিকবার এ নিয়ে কথা বলেছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও আলাপকালে সরকারের এমন অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন ।
বর্তমানে সরকার ভর্তুকি মূল্যে প্রতি কেজি ইউরিয়া সার ১৬ টাকায়, টিএসপি ২২, এমওপি ১৫ ও ডিএপি সার ১৬ টাকায় কৃষকের মাঝে বিতরণ করে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা সারে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় করেছে। আগের দুই অর্থবছরে যা ছিল যথাক্রমে ৬৮৭৫ কোটি টাকা (২০১৯-২০) ও ৭৬৮৩ কোটি টাকা (২০১৮-১৯)।
ভর্তুকির তথ্যে দেখা যায় ২০০৮-০৯ অর্থবছরের পর থেকেই পাঁচ হাজার কোটি থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত এ খাতে সরকার ব্যয় করছে। এরমধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সবচেয়ে কম ৩৪৭০ কোটি এবং ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ১১ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা সারে ভর্তুকি দিয়েছে।
তবে চলতি অর্থবছরে আকস্মিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় সারে ভর্তুকির পরিমাণ চারগুণ বেড়েছে।
সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতি কেজি সারের আমদানি ব্যয় ছিল ইউরিয়া ৩২ টাকা, টিএসপি ৩৩ টাকা, এমওপি ২৩ টাকা ও ডিএপি ৩৭ টাকা।
আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিকেজি ইউরিয়া ৯৬ টাকা, টিএসপি ৭০ টাকা, এমওপি ৫৪ টাকা ও ডিএমপির দাম ৯৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে। কৃষককে আগের দামে দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রতি কেজি ইউরিয়ায় ৮২ টাকা, টিএসপিতে ৫০, এমওপিতে ৪১ ও ডিএপিতে ৭৯ টাকা করে ভর্তুকি দিতে হয়েছে। ফলে ভর্তুকি বাবদ বার্ষিক ব্যয়ের পরিমাণ ২৮ হাজার কোটি থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আভাস দেওয়া হচ্ছে।