বুধবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স ও প্রকৌশল বিভাগের একদল শিক্ষক, গবেষক ও প্রযুক্তিবিদ; নির্বাচন কমিশনের ইভিএম সংশ্লিষ্ট সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের নিয়ে মতবিনিময় করে ইসি।
সভার পর অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং এ কায়কোবাদ সাংবাদিকদের বলেন, ইসির ইভিএম দেখে তারা সন্তুষ্ট হয়েছেন যে এতে কারসাজির কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোটগ্রহণে এক যুগ আগে ইভিএম ব্যবহারের শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে হলেও তার ঘোর বিরোধী বিএনপি।
ইভিএমে ভোটগ্রহণে ফল দ্রুত আসে বলে সরকারি দলের নেতারা এর পক্ষপাতি। অন্যদিকে সরকারবিরোধী দলটির নেতাদের ভাষ্য, যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণে ব্যাপক কারচুপির সুযোগ রয়েছে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নতুন ইসি এ বছরের শুরুতে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেড় বছর বাদে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করছে।
জাফর ইকবাল ‘কনভিন্সড’
ইভিএমের সব দিক বিশ্লেষণ করে মতবিনিময় সভা শেষে জাফর ইকবাল বলেন, “ইভিএম নিয়ে ডেমনস্ট্রেশন পুরোটাই দেখেছি। তার ভেতরের খুঁটিনাটি, টেকনিক্যাল বিষয় যা আছে, তাও জেনে নিয়েছি। সবশেষ আমাদের জন্য রাখা মেশিনটি খুলে দেখেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি কনভিন্সড হয়েছি। অত্যন্ত চমৎকার মেশিন।”
বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত বিষয়ে অনেক এগিয়ে আছে দাবি করে তিনি বলেন, বায়োমেট্রিকসহ এনআইডি পৃথিবীর কম দেশেই আছে। তাই নিজের দেশের উপরে আস্থা রাখতে হবে।
“যেহেতু আমাদের ডেটা রয়েছে, ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করা সম্ভব। একজন মানুষ অন্যের পরিবর্তে ভোট দেওয়ার বিষয়টি মোটামুটিভাবে অসম্ভব কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।… আপাতত ম্যানিপুলেশনের জায়গা নেই। সে ম্যানিপুলেশন করতে হলে যে লেভেলে যেতে হবে, সে লেভেলে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব না।”
ইভিএমের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলকেও প্রতিও যন্ত্রটি ব্যবহারের পক্ষে সায় দেওয়ার অনুরোধ রাখেন।
জাফর ইকবাল বলেন, “সেসব দলকে বলব, খবরের কাগজে দেখেছি তাদের মতো করে নতুন কমিশনও চায়; সে রাজনৈতিক দলকে বলব, আপনাদের মতো করে নতুন কমিশন তৈরি করতে পারেন, তাদেরকে অনুরোধ করব ইভিএম মেশিনটা ব্যবহার করেন।”
কম্পিউটার বিজ্ঞানের এই শিক্ষক বলেন, ইভিএমে কাস্টমাইজেশন দলের প্রতিনিধি, ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে হয়।
“এখন বিশ্বাস করবে কি না, তা রাজনৈতিক ব্যাপার। আমি টেকনিক্যাল বিষয়টা বলেছি। টেকনিক্যাল পয়েন্ট থেকে এর ভেতরে ম্যানিপুলেট করা সম্ভাবনা নেই। ম্যালফাংশন করতে পারে যে কোনো যন্ত্র। তা হলে রিপ্লেস করার সে প্রযুক্তি রয়েছে।”
এই ইভিএম যারা তৈরি করেছেন, তাদের ধন্যবাদ জানান জাফর ইকবাল।
“আমি কনভিন্সড হয়েছি। এটা একদম পারফেক্ট একটা মেশিন । আমাদের দেশের জন্য সহজভাবে চালানো সম্ভব।”
ইভিএমে একজনের ভোট অন্যজনের কাছে পাঠানো সম্ভব কি না- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “এ মেশিনে সেটা সম্ভব না। ভেতরে ঢুকে ম্যানিপুলেট করা ইম্পসিবল। মেশিন হলে কখনও বলবেন না, বলা উচিত না যে শতভাগ হবে। আমরা বলতে পারি যে, কতটুকু পারফেকশনে পৌঁছেছে। যারা ম্যানিপুলেশনের কথা বলে তাদের অনুরোধ করব, তারা যেন সুনির্দিষ্টভাবে লিখিতভাবে বলেন।”
‘ম্যানিপুলেশেনের’ সুযোগ দেখছেন না কায়কোবাদ
বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এ কায়কোবাদ ইভিএমের প্রতি আস্থা রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন এভাবে, এর প্রতিটি অংশ এমনভাবে কাস্টমাইজড, একজন ইচ্ছে করলে সেখানে পরিবর্তন করতে পারবে না।
“কোনো মেশিনকে শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না। তবে এখানে যেটা করা হয়েছে মেশিন লেভেলে আর কোনো কাজ নেই, আর ম্যানিপুলেশনের কোনো সুযোগ নেই।”
রাজনৈতিক দল ও যে কোনো নাগরিকের বোঝার জন্য ইভিএম টেস্ট করার সুযোগ রাখতে পরামর্শ দেন তিনি।
এ প্রযুক্তিবিদ বলেন, “আমি আশা করি, এটা ডিসপ্লে করা হবে। যে কেউ টেস্ট করতে পারবে। ইসি এ কাজ করবে। যে কোনো নাগরিক এসে টেস্ট করতে পারবে, এটা সঠিক হয়েছে দেখতে পারবে।”
ইভিএমের আধুনিকায়নের প্রতিও জোর দেন এম কায়কোবাদ।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যে কোনো মেশিনের জন্য আধুনিকায়ন জরুরি। তবে এটার (ইভিএম) প্রতিটি ছোট ছোট অংশ যেভাবে কাস্টমাইজ করা হয়েছে, এটাকে কেউ এসে ম্যানিপুলেট করবে সেটা সম্ভাবনা নেই। পরামর্শ দিয়েছি- মেশিনটা শুধু ভোট দেওয়াই নয়, যত রকম স্ট্যাটিকটিকস রয়েছে তাও ধীরে ধীরে যুক্ত করার জন্য।”
মতবিনিময় সভায় অংশ নেন বিএমটিএফ’র এমডি মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দীন, সেনা কল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ূন কবীর, আইডিএ প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল কাশেম মো. ফজলুল কাদের, ইভিএম প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান, ইসির সিস্টেম ম্যানেজার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন, বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাহফুজুল ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মতিন সাদ আবদুল্লাহ, এশিয়া প্যাসেফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক অলোক কুমার সাহা, আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ওমর ফারুক, এমআইএসটি-এর কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সিনিয়র ইন্সট্রাকটর গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. আব্দুল হালিম, এশিয়া প্যাসেফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. রাজিবুল ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রণি কুমার সাহা প্রমুখ।
নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর, মো. আনিছুর রহমান এবং ইসি সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন এ সভায়।
আস্থা রাখুন, অপেক্ষা করুন: সিইসি
ইভিএম নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এখানে ম্যানিপুলেশনের সুযোগ নেই। এজন্যে আমাকে আস্থা রাখতে হবে ওইসব মানুষের উপর যেসব মানুষ এসব জিনিস বোঝেন। তাদের উপর আস্থা রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, “এ যন্ত্র যারা বানিয়েছেন, তারা প্রশংসিত হয়েছেন। এ ধরনের যন্ত্র যথেষ্ট উন্নতমানের।
রাজনৈতিক দলগুলোর ‘টেকনিকাল পারসন’দেরও এমন সভায় ডাকার পরিকল্পনা রয়েছে ইসির।
সিইসি বলেন, “আমরা কারও মতামতকে উপেক্ষা করিনি। বিরোধী দল থেকে যে অভিযোগ এসেছে, যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিইনি। আমরা ইন্টারনালি কিছু বৈঠক করেছি। আজকে ৮-১০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, যাদের কাছ থেকে জানা প্রয়োজন জেনেছি, আরেও জানবো। মেশিনের ভালো খারাপ দিক নিয়ে আজকে বলব না। আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।”
যারা আপত্তি তুলেছেন, তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাইবেন বলে জানান তিনি।
“রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা মাঠে বলছেন এটা ভালো মেশিন নয়, মন্দ মেশিন। তাদের কাছ থেকে হয়তবা জানতে চাইবো লিখিতভাবে আপনারা কী কী সমস্যা ভোগ করছেন, আমাদেরকে অবগত করেন। আমরা যেন সিস্টেমেটিক্যালি এগুলো এড্রেস করতে পারি, সুযোগ পাই।”
পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি বলে জানান হাবিবুল আউয়াল।
“আমরা তো ইভিএম নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা ৩০০ আসনে করব, না কি ১০০ আসনে করব, না কি মোটেই করব না- আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করে দ্যান উইল বি কামিং ইন এ পজিশন টু ডিসাইড। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সিদ্ধান্ত নেব।”
আরও পড়ুন: