বরাবর
স্পিন সহায়ক হলেও মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের পিচ এবার ধরা দিয়েছে ভিন্ন রূপে।
শ্রীলঙ্কার হয়ে তিন স্পিনার হাত ঘুরিয়ে কোনো উইকেট পাননি। উইকেট থেকে খুব একটা সহায়তাও
মেলেনি তাদের জন্য। বাংলাদেশের হয়েও মোসাদ্দেক হোসেন খরুচে দুটি ওভারের পর আর বোলিং
পাননি, মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত বোলিং করতে পারলেও উইকেট পাননি তাইজুল ইসলাম। ব্যতিক্রম
কেবল সাকিব।
স্পিনারদের
এই বিবর্ণ মঞ্চেই তিনি দারুণ উজ্জ্বল। লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের ভাবিয়েছেন, ভুগিয়েছেন।
নিজের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার মেলে ধরেছেন, স্কিলের গভীরতা ফুটিয়ে তুলেছেন, বুদ্ধির ঝলক দেখিয়ে
দিয়েছেন। ২৬ ওভারে ৫৯ রান দিয়ে ৩ উইকেট, মিরপুর টেস্টে এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সফলতম
বোলার সাকিব। লঙ্কানদের লাগাম নেওয়ার চেষ্টায় বারবার বাধ সেধেছেন তিনিই।
দ্বিতীয়
দিন শেষ বিকেলে দারুণ এক ডেলিভারিতে আউট করেছিলেন তিনি কুসল মেন্ডিসকে। পিচ করে সোজা
আসা বলের জবাব পাননি মেন্ডিস। তৃতীয় দিনে জাদুকরি এক ডেলিভারিতে তিনি সরিয়ে দেন বাংলাদেশের
সামনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানো দিমুথ করুনারত্নেকে।
অথোর্ডক্স
স্পিনের সঙ্গে যদিও জাদুকরি কিংবা মোহনীয় ব্যাপারগুলি খুব একটা যায় না। রিস্ট স্পিনের
মতো কব্জির কারিকুরি বা ঘোর লাগানোর মতো কিছু এখানে থাকে না। সাকিব তবু উপহার দিলেন
চমকপ্রদ এক মুহূর্ত।
সকালে
যদিও শুরুতে একটু জোরে বোলিং করছিলেন তিনি। তবে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দারুণ ফ্লাইট দিতে
থাকেন। সেই ফ্লাইট আর লেট ড্রিফটে ধরা দেয় করুনারত্নের উইকেট।
ওই
ওভারেও প্রথম বলটি খাটো লেংথে করেছিলেন সাকিব, যেটি কাজে লাগিয়ে বল বাউন্ডারির দিকে
পাঠান অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস। বদলি ফিল্ডার নুরুল হাসান সোহানের অসাধারণ ক্ষীপ্রতায় বাউন্ডারি
বাঁচানো যায়, তবে তিন রান ঠিকই হয়। চতুর্থ বলটিও ছিল শর্ট, এটিতে কাট করে করুনারত্নে
মারেন চার।
পরের
বলটি সাকিব দেন অনেক ঝুলিয়ে। করুনারত্নেকে শট খেলার আমন্ত্রণ যেন। তবে সেই ডাক উপেক্ষা
করে অনায়াসে ডিফেন্স করেন করুনারত্নে। এরপর সেই আলোচিত ডেলিভারি। সাকিব ডেলিভারি করেন
ক্রিজের প্রায় একই জায়গা থেকে, বল ছাড়েন প্রায় একই উচ্চতায়। ফ্লাইট ঠিক একইরকম। এবার
বলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ড্রাইভ করতে গেলেন করুনারত্নে। ব্যস, দরকার ছিল এটিই!
একটু
টেনে করা ডেলিভারির পিচ পর্যন্ত পুরো যেতে পারলেন না করুনারত্নে, লেট ড্রিফটের কারণে
ভুল করলেন লাইন কাভার করতে। সর্বনাশ হয়ে গেল তাতেই। ব্যাট-প্যাডের মধ্যে তৈরি হলো ফাঁক,
বল সেই পথ ধরে এগিয়ে টার্ন করে ছোবল দিল স্টাম্পে।
প্রায়
সাড়ে ৪ ঘণ্টা উইকেটে কাটানো করুনারত্নে বোল্ড হয়ে ফিরলেন ৮০ রানে।
শেষ
সেশনে দারুণ ফ্লাইট ও টার্নে সাকিব আউট করেন ৫৮ রান করা ধনাঞ্জয়া ডি সিলভাকেও।
শুধু
এই টেস্ট নয়, সিরিজের প্রথম টেস্টে চট্টগ্রামেও দুর্দান্ত বোলিং করেন সাকিব। কোভিডের
কারণে ওই টেস্টে তার খেলার কথা ছিল না। পরে সেরে উঠলেও টেস্টের আগে একদিনের প্রস্তুতি
পর্বে কোনো বোলিং করেননি। তার পরও প্রায় ৫ মাস পর লাল বল হাতে নিয়েই আরেকবার চিনিয়ে
দেন নিজের জাত।
চট্টগ্রামে
উইকেট ছিল ব্যাটিং বান্ধব। সেই উইকেটেও বোলিং মাস্টারক্লাস মেলে ধরে ম্যাচে নেন ৪ উইকেট।
বাংলাদেশের
হয়ে অবশ্য পারফর্ম করে আসছেন তিনি বছরের পর বছর ধরেই। তবে অ্যালান ডোনাল্ড তাকে কাছ
থেকে দেখছেন অল্প কদিন ধরে। যা দেখছেন, তাতে ভালো লাগার শেষ নেই বাংলাদেশের বোলিং কোচের।
দক্ষিণ আফ্রিকান কিংবদন্তি এবি ডি ভিলিয়ার্সের কথা ধরেই ডোনাল্ড বোঝাতে চাইলেন, বোলার
সাকিবের জায়গা কতটা উঁচুতে।
“এমন
একজনকে আর কী-ই বা শেখানো যায়, এটাই আমার প্রশ্ন! সে শেন ওয়ার্নের মতো… এত অভিজ্ঞ,
এত সফর করেছে…। নিজের কাজ সে করেই যাচ্ছে, এতটা নিয়ন্ত্রণ তার বোলিংয়ে। আমি জানি, সে
এবং রাঙ্গা (স্পিন কোচ রঙ্গনা হেরাথ) বেশ ঘনিষ্ঠ, যখনই টুকটাক কথা বলার প্রয়োজন হয়।
নিজের আপন জগতে সাকিব যখন স্পিন বোলিং নিয়ে কথা বলে, শুনতে দারুণ লাগে।”
“সবসময়ই
সাকিবে গুণমুগ্ধ আমি। আজকে ডাগআউটে বসে কয়েকজনকে বলছিলাম, এবি ডি ভিলিয়ার্স যখন বলে
যে সাকিবকে সামলানো কঠিন, তখন তা সত্যিই কঠিন। সে স্মার্ট অপারেটর। সে বলের গতি পরিবর্তন
করে ভীষণ সূক্ষ্মভাবে। আজকেও সে তা দেখিয়েছে। নিজের কাজ করে গেছে বারবার।”
ডোনাল্ডের
আশা, চতুর্থ দিন সকালে ৫ উইকেট পূর্ণ করবেন সাকিব।
“আশা
করি, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সে ৫ উইকেট নিয়ে মাঠ ছাড়বে। তার মতো একজনকে পাওয়া দলের
জন্য দারুণ। তার অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্ব দলের জন্য অমূল্য।”