ক্যাটাগরি

দেশে দেশে খাদ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বাড়াচ্ছে উদ্বেগ

বিবিসি জানায়, মালয়েশিয়া সোমবার তাদের মুরগি রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী জুন মাস থেকে যা কার্যকর হবে।

এর আগে ভারত তাদের গম রপ্তানিতে এবং ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে প্রায় দুই বছর বিশ্ব অর্থনীতি বলতে গেলে অচল হয়েছিল। টিকা আবিষ্কারের পর মহামারীর ভয় কাটিয়ে বিশ্ব যখন সবে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করেছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেইনে আক্রমণ করে বসে রাশিয়া।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এই দুই দেশই বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্যের অন্যতম বড় যোগানদাতা দেশ।

এখন যুদ্ধের কারণে ইউক্রেইন থেকে সব ধরনের পণ্য রপ্তানি বন্ধ আছে। অন্যদিকে, ইউক্রেইনে আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমা বিশ্ব কঠোর থেকে কঠোরতর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে চাইছে। ফলে রাশিয়ার খাদ্যপণ্য রপ্তানিও প্রায় বন্ধ হওয়ার যোগাড়।

এর প্রভাব পড়েছে পুরো বিশ্বজুড়ে। ভোজ্যতেল নিয়ে কাড়াকাড়ির মাধ্যমে যে সঙ্কটের নগ্ন চেহারা বিশ্ববাসীর সামনে এসেছিল তা এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের বেলাতেই প্রকট হয়েছে।

ইউক্রেইনে যুদ্ধের জের বিশ্ব জুড়ে যে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা অতীতের কয়েক দশকের মধ্যে দেখা যায়নি।

অবস্থা যখন এতটাই সঙ্কটময় তখন নানা দেশ অভ্যন্তরীণ বাজার ঠিক রাখতে যেভাবে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে তা ‘খুবই উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেন কৃষি বিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ। যেটিকে বলা হচ্ছে ‘খাদ্য জাতীয়তাবাদ’।

বিবিসি জানায়, গত কয়েক মাসে মালয়েশিয়ায় মুরগির দাম অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়া, খুচরা দোকানগুলোতে একজন বিক্রেতা একবারে কতটা মাংস কিনতে পারবেন তার উপরও সীমাবদ্ধতা টেনে দেওয়া হয়েছে।

এরমধ্যে সোমবার এক বিবৃতিতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকব বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত এবং উৎপাদন স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত’ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটি প্রতি মাসে ৩৬ লাখের বেশি মুরগি রপ্তানি বন্ধ রাখবে।

‘‘সরকারের কাছে আমাদের জনগণই সবার আগে।”

মালয়েশিয়ার এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে প্রতিবেশী দেশ সিঙ্গাপুর। মালয়েশিয়ার মোট মুরগি রপ্তানির একতৃতীয়াংশ যায় সিঙ্গাপুরে।

সিঙ্গাপুর সাধারণত জীবন্ত মুরগি আমদানি করে।

মালয়েশিয়ার মুরগি রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার দিনই সিঙ্গাপুরের ফুড এজেন্সি থেকে ক্রেতাদের ‘ফ্রোজেন চিকেন’ কিনতে উৎসাহ দেওয়ার পাশপাশি আতঙ্কিত হয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য না কেনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

যুদ্ধের প্রভাব

সর্বশেষ মালয়েশিয়ার মুরগি রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা বিশ্বজুড়ে খাদ্যপণ্য সঙ্কটকে আরো জটিল করে তুলবে।

বিশ্ব ব্যাংক থেকে গত মাসে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছিল, খাদ্যের দামের রেকর্ড ঊর্ধ্বগতি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য সীমার নিচে ঠেলে দেবে এবং তারা অপুষ্টিতে ভুগবে।

ইউক্রেইন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গম রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তাদের গম রপ্তানি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। যার প্রভাবে বিশ্বজুড়ে গমের দাম বেড়েছে। অন্যদিক, লাখ লাখ টন গম ইউক্রেইনের গুদামগুলোতে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।

সোমবার ইউক্রেইনের ফার্স্ট উপ প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া সভিরিডেঙ্কো এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেন, আন্তর্জাতিক মহলের উচিত এমন একটি ‘নিরাপদ পথ’ সৃষ্টি করা, যেটি দিয়ে ইউক্রেইন সেখানে পড়ে থাকা লাখ লাখ টন গম রপ্তানি করতে সক্ষম হয়।

সুইজারল্যন্ডের ডাভোসে চলছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলন। সেখানে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের খাদ্য প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলি বলেন, ইউক্রেইনের খাদ্য রপ্তানিতে রাশিয়ার বাধা ‘বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সামিল’।

‘‘অথচ এইমধ্যে আমাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে মারাত্মক খাদ্য সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

‘‘ইউক্রেইন থেকে আসা খাবার দিয়ে বিশ্বের চার কোটি মানুষের অন্নের সংস্থান করা হতো। যখন আপনি তাদের কাছ থেকে সেটা কেড়ে নেন, তাদের খাবারের যোগান বন্ধ করে দেন এবং তার উপর আপনি যখন সার সঙ্কট, খরা, খাবারের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি সংকট চাপিয়ে দেন, তখন আমরা পৃথিবীতেই নরকপ্রলয় দেখতে পাচ্ছি।” 

খাদ্য জাতীয়তাবাদ কী কাজে দেবে?

এ মাসের শুরুতে ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করলে বিশ্ববাজারে গমের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। তাপদাহের কারণে প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। যার ফলে ভারত সরকার গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এদিকে, বন্যা এবং খরার করণে অন্যান্য বৃহৎ গম উৎপাদনকারী দেশও ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

অথচ, ব্যবসায়ীরা আশা করেছিল ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গমের যোগানে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা ভারত পূরণ করতে পারবে।

ইন্দোনেশিয়া তিন সপ্তাহ আগে তাদের পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বিশ্ববাজারে এই ভোজ্য তেলের দাম অনেক বেড়ে যায়। খাদ্যপণ্য থেকে কসমেটিস কোথায় নেই পাম অয়েলের ব্যবহার।

ইন্দোনেশিয়া সরকার বলেছিল, দেশের বাজারে দাম কমিয়ে আনতে ওই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সোমবার নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়েছে। নতুন করে আর কোনো ঘোষণা না আসলেও এ নিয়ে স্বস্তির অবকাশ এখনো নেই।

এই যে ‘খাদ্য জাতীয়তাবাদ’ এটা আসলে কতটা কার্যকর। এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরের সহকারী অধ্যাপক সোনিয়া আকতার বিবিসিকে বলেন, ‘‘সরকারগুলো এই ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণ, তারা মনে করে তাদের নাগরিকদের প্রথমে এবং সর্বাগ্রে রক্ষা করতে হবে।

“২০০৭-২০০৮ সালের খাদ্য সংকটের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আরও বেশি সংখ্যক দেশ এটি (খাদ্য জাতীয়তাবাদ) অনুসরণ করবে। যা সঙ্কট বাড়ার পাশাপাশি খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে।”

খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বা এই ‘খাদ্য জাতীয়তাবাদ’ স্থায়ী নয় বরং সাময়িক সময়ের জন্য বলে আশা প্রকাশ করেছেন সিঙ্গাপুরের আরেক অধ্যাপক উইলয়াম চেন।

তিনি বলেন, ‘‘অন্যান্য দেশ খাদ্য পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, কিন্তু পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।

“এটি খাদ্য মূল্য শৃঙ্খলের আন্তঃসংযোগের একটি ভালো প্রতিফলন, কারণ, কোনও দেশের পক্ষেই নিজেদের জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় সব খাবারের সরবরাহ পেতে শুধু নিজেদের উপর নির্ভর করা সম্ভব না।”