র্যাব বলছে, জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের সাবেক এ আমির ১৩ বছর ধরে ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ছেলের বাড়িতে থাকছিলেন। ঘর থেকে খুব বেশি বের হতেন না। সেখান থেকেই বুধবার তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে তিন বছর তিনি আত্মগোপনে ছিলেন কুমিল্লার গৌরীপুরে শ্বশুরবাড়ি এলাকায়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে বৃহস্পতিবার দুপুরে এ জঙ্গি নেতাকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার আল মঈন জানান, আব্দুল হাই রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলা এবং গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা মামলায় পৃথকভাবে মৃত্যুদণ্ড পান। ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলায় তিনি যাবজ্জীবন দণ্ড পেয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলারও অভিযোগপত্রভুক্ত পলাতক আসামি তিনি।
“সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে সাতটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, যার মধ্যে দুইটি মৃত্যুদণ্ড ও দুইটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ১৩টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।”
বুধবার সন্ধ্যায় র্যাব-২ এর একটি দল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থেকে মুফতি আব্দুল হাইকে গ্রেপ্তার করে উল্লেখ করে সংস্থার কর্মকর্তা মঈন জানান, তিনি সেখানে ২০০৯ সালের পর থেকে অবস্থান করছিলেন। আব্দুল হাইয়ের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে।
মুফতি হাই নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ মাদরাসায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত হেফজ বিভাগে পড়ালেখা করে জানিয়ে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, “এরপর ১৯৮১ সালে অবৈধভাবে ভারতে গিয়ে দেওবন্দ দারুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দেওবন্দে থেকে মাস্টার্স সমতুল্য দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। দেওবন্দে থাকার সময় তিনি ভারতের পাসপোর্ট তৈরি করেন। ১৯৮৫ সালের শেষদিকে ওই পাসপোর্ট নিয়ে ভারতের নাগরিক হিসেবে তিনি বাংলাদেশে আসেন, ১৯৮৬ সালে আবার চলে যান।”
পরে ভারতের পাসপোর্টে তিনি পাকিস্তানের ভিসা নিয়ে করাচিতে যান উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পাকিস্তানের একটি মাদরাসা থেকে দুই বছরের ইফতা কোর্স সম্পন্ন করে ‘মুফতি’ টাইটেল নেন তিনি। ১৯৮৯ সালে দেওবন্দ মাদরাসার একাধিক বাংলাদেশি ছাত্রসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি মিরানশাহ বর্ডার দিয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে (মুজাহিদ হিসেবে) যান। সেখানে তারা একে-৪৭ রাইফেল ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন।
আফগানিস্তানে থাকার সময়ই বাংলাদেশি যোদ্ধারা হুজি-বি বা হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে বলে জানাচ্ছে র্যাব। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে আব্দুল হাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই সংগঠনের প্রচারণা শুরু করেন। এরপর ১৯৯২ সালে কক্সবাজারের উখিয়ার একটি মাদরাসায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করেন তিনি।
র্যাব বলছে, পাশের দেশের এক জঙ্গি নেতা ওই ক্যাম্পে অস্ত্র দিত, আর আব্দুল হাই ও তার দুই সহযোগী সেখানে প্রশিক্ষণ দিত। ১৯৯৬ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানে ওই ক্যাম্প থেকে ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শ্বশুরের দোকানের কর্মচারী হিসেবে ৩ বছর
র্যাব জানায়, মুফতি আব্দুল হাই ‘জাগো মুজাহিদ’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পত্রিকাটি ১৯৯১ সালে চালু হয়, অফিস ছিল খিলগাঁও থানার তালতলায়। পরে ২০০০ সালে সরকার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে। ওই সময় অফিস থেকে গ্রেপ্তার হওয়া আব্দুল হাই জামিনে মুক্তি পান দুই মাস পরই।
বিভিন্ন জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে হরকাতুল জিহাদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে ২০০৬ সালের পর আব্দুল হাই আত্মগোপনে চলে যান। তার পরিবার তখনও নারায়ণগঞ্জে থাকতো। র্যাব বলছে, সেসময় তিনি কুমিল্লার গৌরীপুরে শ্বশুরবাড়ি এলাকায় আত্মগোপনে ছিলেন। গৌরীপুর বাজারে শ্বশুরের কেরোসিন ও সয়াবিন তেলের ডিলারশিপের ব্যবসা দেখাশোনা করে রাতে সেখানেই থাকতেন। এভাবে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি গৌরীপুরে আত্মগোপনে ছিলেন। মাঝেমধ্যে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ যাতায়াত করতেন।
২০০৯ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জে
পরে আব্দুল হাই পরিবারের সবার ঠিকানা পরিবর্তন করে নারায়ণগঞ্জে ভোটার হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। র্যাবের ভাষ্য, স্থানীয়রা যেন তার পরিচয় জানতে না পারে, সেজন্য ঘর থেকে খুব কম বের হতেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে বর্তমান ঠিকানার বাড়িটিকে এলাকার লোকজনের কাছে বড় ছেলের বাসা বলে পরিচিতি করায়।