ক্যাটাগরি

এনআরএ: যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ঠেকিয়ে রেখেছে যে সংগঠন

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টেক্সাসের ঘটনার পর জাতির সামনে প্রশ্ন রেখেছেন, “আমরা কবে আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে ওকালতি করা লবির বিরুদ্ধে অবস্থান নেব?”

মঙ্গলবার ১৮ বছর বয়সী এক বন্দুকধারী রব এলিমেন্টারি স্কুলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালানো শুরু করে, পরে পুলিশের গুলিতে বন্দুকধারী নিজেও নিহত হয়। ওই ঘটনায় নিহত ২১ জনের মধ্যে ১৯ জনই শিশু।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন স্কুলে এভাবে সশস্ত্র হামলার ঘটনা এখন মহামারীর চেহারা পেয়েছে। নেভাল পোস্টগ্রাজুয়েট স্কুলের সেন্টার ফর হোমল্যান্ড ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটির কে-টুয়েলভ স্কুল শুটিং ডেটাবেইজের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এ পর্যন্ত দেশটির স্কুলগুলোতে ১৩৭টি গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হামলাকারীরা বয়সে কিশোর বা তরুণ।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্কুলে হামলা হলে নিরাপত্তার জন্য কী করতে হবে, সেই প্রশিক্ষণও বিদ্যালয়ের নিয়মিত পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, বিভিন্ন রাজ্যের আইনে সহজেই অস্ত্র কেনার বা সংগ্রহ করার সুযোগ থাকায় বন্দুকবাজি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

কঠোর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই বিক্ষোভ, সমাবেশ হয়; ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিবিদরাও এর পক্ষে বক্তব্য দেন নিয়মিত। কিন্তু রিপাবলিকানদের শক্ত বাধার মুখে অস্ত্র বিক্রির ওপর কড়াকড়ি আরোপের সব চেষ্টাই ভেস্তে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানা ও বহনের অধিকারের পক্ষে প্রভাবশালী যে সংগঠনটি সবচেয়ে বেশি ওকালতি করে যাচ্ছে, তার নাম এনআরএ। এ সংগঠনের ক্ষমতা উৎস জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

এনআরএ কি?

এনআরএ হচ্ছে ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের সংক্ষিপ্ত রূপ। যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধের দুই সাবেক যোদ্ধা ১৮৭১ সালে শৌখিন শুটারদের এই সংগঠন গড়ে তোলেন। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে রাইফেলের গুলি ছোড়ার কৌশল শেখানো হত এই ক্লাবে। 

এনআরএ রাজনৈতিক অঙ্গনে তদবিরের পথে হাঁটতে শুরু করে ১৯৩৪ সালে। ওই সময় আসন্ন আগ্নেয়াস্ত্র বিলের তথ্য জানাতে সমিতির সদস্যদের চিঠি পাঠানো শুরু করে সংগঠনটি।

১৯৩৪ সালের ন্যাশনাল ফায়ারআর্মস অ্যাক্ট (এনএফএ) এবং ১৯৬৮ সালের গান কন্ট্রোল অ্যাক্ট (জিসিএ) পাসের পক্ষে সমর্থন জানানো হয় এনআরএর পক্ষ থেকে।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে জিসিএ কার্যকরের পর থেকে এ সমিতি আরও বেশি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সরাসরি সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করতে তদবির চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৭৫ সালে তারা ইনস্টিটিউট ফর লেজিসলেটিভ অ্যাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। আইনপ্রণেতাদের তহবিল যোগান দিতে ১৯৭৭ সালে নিজেদের পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (পিএসি) গড়ে তোলে এনআরএ।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে শক্তিশালী লবি গোষ্ঠীগুলোর একটি এই এনআরএ। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ নীতির বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের প্রভাবিত করার জন্য তাদের বিপুল বাজেট রয়েছে। এই লবি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে আছেন এনআরএ এর নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়েইন লাপিয়ের।

এই লবি গোষ্ঠীকে ভেঙে দিতে নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটন ডিসিতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কৌঁসুলিরা। তাদের অভিযোগ, সমিতির শীর্ষ নেতৃত্ব দাতব্য তহবিলের অপব্যবহার করেছে, তহবিলের অর্থ ব্যক্তিগত বিলাসবহুল জীবন যাপনে ব্যয় করেছে।

ওই মামলাকে একটি ‘ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে এনআরএ।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

এনআরএ এর কত টাকা?

২০২০ সালের একটি হিসাব বলছে, এনআরএ বছরে ২৫ কোটি ডলার খরচ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ওকালতি করে যাওয়া সবগুলো গোষ্ঠীর মোট বাজেটের চেয়েও বেশি।

অবশ্য বিরোধীদের তুলনায় এনআরএ এর সদস্য সংখ্যাও অনেক বেশি। তারা তাদের বাজেটের অর্থ শুটিং রেঞ্জ পরিচালনা এবং প্রশিক্ষণের মত কাজে খরচ করে।

আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অধিকারের পক্ষে তদবির বা লবি করার জন্য এনআরএ বছরে আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০ লাখ ডলার খরচ করে। ২০১৪ সালে তারা ৩৩ লাখ ডলার খরচের হিসাব কাগজেপত্রে দেখিয়েছে, যেটা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

ওই অর্থ তারা আইন মেনে লবি বা তদবির করার জন্য খরচ হিসেবে দেখিয়েছে, যা আইনপ্রণেতাদের পেছনে ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির মাধ্যমে এবং ব্যক্তি পর্যায়ে আরও বিভিন্ন জায়গায় তারা অর্থ খরচ করে, যার হদিস বের করা কঠিন।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এনআরএ তাদের রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় সদস্যদের মাধ্যমে বড় ধরনের পরোক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব ধরে রেখেছে, যাদের অনেকেই কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে ভোটের হিসাব বদলে দিতে পারে।

এনআরএ প্রকাশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের ‘এ’ থেকে ‘এফ’ শ্রেণিতে বিভক্ত করে থাকে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের নীতির পক্ষে রাজনীতিবিদদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে এই শ্রেণিকরণ করা হয়। নির্বাচনেও এসব রেটিং গুরুতর প্রভাব ফেলে এবং ওই তকমার কারণে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে অবস্থান নেওয়া একজন প্রার্থী নির্বাচনে হেরেও যেতে পারেন।

২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর রাজনৈতিক প্রচারে এনআরএ এর খরচ কমেছে। অন্যদিকে এই সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে প্রচার চালানো গোষ্ঠীরা এনআরএ-বিরোধীদের কাছ থেকে বিপুল চাঁদা পেয়েছে।

একটি হিসাব থেকে ধারণা করা হয়, প্রথমবারের মতো ২০১৮ সালে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষের শক্তি রাজনৈতিক খাতে খরচের ক্ষেত্রে এনআরএকে পেছনে ফেলেছে।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

এনআরএ কত বড়?

কয়েক দশক ধরেই এনআরএ এর সদস্য সংখ্যা নিয়ে মতভেদ চলে আসছে। সমিতির দাবি, ২০১২ সালে স্যান্ডি হুক স্কুলের গোলাগুলির পর তাদের সদস্য সংখ্যা ৫০ লাখের কাছাকাছি পৌঁছায়।

অবশ্য কিছু বিশ্লেষকের ধারণা, এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ৩০ লাখের মত; প্রভাব দেখাতে তারা সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে বলে।

এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন- এমন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচডব্লিউ বুশও রয়েছেন। তিনি ১৯৯৫ সালে সমিতি থেকে পদত্যাগ করেন।

বর্তমান সদস্যদের মধ্যে আছেন সাবেক ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সারাহ পেলিন, অভিনয় শিল্পী টম সেলেক ও হুপি গোল্ডবার্গ।

প্রয়াত অভিনেতা চার্লটন হেস্টন ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ মেয়াদে এনআরএ এর সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৯ সালে কলাম্বাইন হাই স্কুলে নির্বিচার গুলির ঘটনার পর এনআরএ সম্মেলনে মাথার ওপর রাইফেল তুলে তিনি বন্দুক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “তারা যদি এটা কেড়ে নিতে চায়, তাদের নিতে হবে আমাদের ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া লাশের হাত থেকে।”

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

এই সমিতি কেন বিতর্কিত?

সব ধরনের বন্দুক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে তদবির করে এনআরএ এবং তারা দাবি করে, আরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র দেশকে আরও নিরাপদ করবে।

সমিতির এই অবস্থানের ভিত্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর একটি ব্যাখ্যা, যেখানে সরকারি তদারকি ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে অস্ত্র রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

স্যান্ডি হুক স্কুলে গোলাগুলির ঘটনায় এনআরএকে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট- দুই পক্ষ থেকেই সমালোচনা শুনতে হয়েছিল, ওই সময় সমিতির সভাপতি লাপিয়েরে যুক্তি দিয়েছিলেন, স্কুলে সশস্ত্র রক্ষী না থাকার কারণেই মর্মান্তিক ওই ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় আইনসভায় বন্দুকের মালিকানা সীমিত করার যে কোনো উদ্যোগের নিরবচ্ছিন্ন বিরোধিতা করে আসছে এনআরএ।

তারা অপরাধীদের কাছ থেকে পুলিশের জব্দ করা আগ্নেয়াস্ত্র নষ্ট না করে আবার বাজারে বিক্রির পক্ষে তদবির করেছে। তাদের যুক্তি, একটি চমৎকার অস্ত্র নষ্ট করে ফেলা এক ধরনের অপচয়।

একইভাবে তারা বন্দুক বহনের অধিকার বাড়ানোর আইনের পক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছে, যেমন ‘ওপেন-ক্যারি’ আইন, যে আইনের অধীনে আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক বেশিরভাগ জনসমাগম স্থানে তার আগ্নেঅস্ত্র প্রদর্শন করতে পারবেন।