বিশ্বের ২১টি দেশে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষের শরীরে ছড়ানো এ ভাইরাসের সংক্রমণের মাত্রা মৃদু। তাই ফুসকুড়ি উঠলেই তা মাঙ্কিপক্স ধরে নেওয়ার কারণ নেই।
জলবসন্ত, খোসপাঁচড়া বা চুলকানি, ছারপোকা বা অন্য পোকামাকড়েরর কামড় কিংবা অ্যালার্জির কারণেও ফুসকুড়ি উঠতে পারে। এক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো মনে রাখা দরকার, তা তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক বিশ্লেষণে।
আসলেই মাঙ্কিপক্স?
গায়ে হঠাৎ ফুসকুড়ি উঠলে প্রথমে ভেবে দেখতে হবে- মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা। লম্বা সময় মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে থাকা বা শারীরিক সংস্পর্শে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বিশ্বে কেবল অল্প কিছু মানুষের এই রোগ ধরা পড়েছে। অর্থাৎ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার সুযোগ এখনও খুবই কম।
আফ্রিকার কিছু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ রোগের সংক্রমণ আগেও হয়েছে। তবে শিশুরা খুব কমই আক্রান্ত হয়েছে।
মাঙ্কিপক্সে অসুস্থ হয়ে পড়লে শুরুর দিকে ফ্লু-এর মতো লক্ষণ থাকে। যেমন- ক্লান্ত বোধ করা, অসুস্থ বোধ হওয়া এবং জ্বর। চিকিৎসকরা বলছেন, মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস কোষে প্রবেশ করার সময় ওই উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে।
তখন গ্রন্থিগুলো ফুলে যায়, কারণ মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুরু করে।
এরপর চামড়া ভেদ করে ফুসকুড়ি বের হয়। শুরুতে তা মসৃণ ও লাল হলেও পরে উচু-নিচু ফোসকার আকার নেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইমার্জেন্সি প্রোগ্রামের চিকিৎসক রোসামুন্ড লুইস বলেন, “একে আমরা ম্যাকুলস (ক্ষত অংশ) বলি। এর ফলে ত্বকের কিছু অংশ লাল হয়ে যায়। তারপর এটা প্যাপিউলে (ব্রনের মত ফোড়া) পরিণত হয়। আপনি সেটা আলাদা করে অনুভব করতে পারবেন। বুঝতে পারবেন যে সেটা বেড়ে উঠছে।”
ত্বকের বেড়ে ওঠা সেই লাল ফুসকুড়ি ফোস্কা হয়ে ভেতরে পুঁজের মতো দেখতে সাদা তরলে ভরে যায় এরপর। এগুলো পরে শুকিয়ে ক্ষত আকারে খোসপাঁচড়ার রূপ নেয়। ধীরে ধীরে সেগুলো সেরে যাবে।
লুইস বলেন, “যেভাবে এটা হয়, তাতে জলবসন্তের সঙ্গে গুলিয়ে যেতে পারে।”
বিবিসি লিখেছে, মাঙ্কিপক্সের ফুসকুড়ি সাধারণত শুরুতে মুখের অংশে দেখা দেয়। তারপর বাহু, হাত, পা, পায়ের পাতা এবং পুরো শরীরে ছড়াতে পারে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আবার যৌনাঙ্গের আশেপাশেও এসব ফুসকুড়ি দেখা গেছে।
বিভিন্ন রকম ত্বকে এই ফুসকুড়ির চেহারা হতে পারে বিভিন্ন রকম। বিছানার চাদর এবং কাপড়চোপড়ের মাধ্যমেও এটা ছড়াতে পারে।
যুক্তরাজ্যের হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সি ত্বকের অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা ক্ষত সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, বিশেষ করে যৌনাঙ্গের আশেপাশে যদি এরকম কিছু দেখা যায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ডার্মাটোলজিস্টের সভাপতি ডা. তানিয়া ব্লেইকার বলেছে, “বিভিন্ন ধরনের ফুসকুড়ির কারণে এগুলোর মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হতে পারে। তাই সন্দেহ হলে পরামর্শ মেনে চলা এবং পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া ভালো।”
আর কী কী কারণে ফুসকুড়ি হতে পারে
ত্বকের ফুসকুড়ি অনেক কারণে হতে পারে। তবে সচরাচর যে কারণে হয়ে থাকে তা হল-
জলবসন্ত
এ ধরনের ফুসকুড়ি সাধারণত খুব চুলকায় এবং খোসপাচড়ার চেহারা পাওয়ার পর তা নিরাময় হয়ে যায়। কেউ কেউ জীবনে একাধিকবার এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
ছোটবেলায় জলবসন্ত বা চিকেনপক্স হলেও প্রাপ্তবয়স্কদের আবার এ রোগ হতে পারে। এ ভাইরাস পুনরায় সক্রিয় হয় কোমর বা কুঁচকিতে দাদের মত চর্মরোগের মাধ্যমে।
জলবসন্তেও ফুসকুড়িও হয়। ত্বকে ফুসকুড়ি বা ব্রনের মতো দাগ দেখা যায়, সেখানে ব্যথাও হয়।
চুলকানি
সাধারণত ত্বকে কোনো ক্ষুদ্র পরজীবী ডিম পাড়লে তা থেকে চুলকানি হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে খুব চুলকায় এবং লাল হয়ে যায়। শরীরের যে কোনো জায়গায় তা হতে পারে। তবে সাধারণত আঙ্গুলের মাঝে হয়। আক্রান্ত অংশে চিহ্ন হিসেবে ফোটা ফোটা বিন্দুর মত দেখা যায়। চুলকানি খুব গুরুতর কিছু না হলেও এটি খুব সংক্রামক। সেজন্য চিকিৎসা প্রয়োজন।
ছারপোকা বা অন্য পোকামাকড়ের কামড়
বিছানায় ঘুমাতে গেলে শরীরে ছারপোকা কামড়াতে পারে। সেগুলো অনেক ছোট হওয়ায় অনেক সময় চোখে পড়ে না। অন্যান্য পোকামাকড়ের কামড়েও ক্ষত অংশে চুলকায় এবং লাল হয়ে যায়। আক্রান্ত জায়গায় দাগ বা গুচ্ছ গুচ্ছ দাগ থাকে।
সংক্রামক যৌনব্যাধি
সিফিলিস বা জেনিটাল হার্পিসের মত সংক্রামক যৌন ব্যাধির কারণেও আক্রান্ত অংশে ফুসকুড়ি উঠতে পারে।
সিফিলিস হয় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে, যা সাধারণত সংক্রামিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায়। আর হার্পিস হয় ভাইরাসের মাধ্যমে। এটাও সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ফলে অন্যের দেহে ছড়িয়ে পড়ে।
উভয় ক্ষেত্রেই ত্বকে ফোস্কা হতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করে চিকৎ করা গুরুত্বপূর্ণ।
হাইভস/অ্যালার্জি/আর্টিকারিয়া
চুলকানি, হুল ফোটানোর মতো লাল ফুসকুড়ি দেখা যায় শরীরে। কখনও কখনও এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে সাধারণ কিছু খাবার বা নির্দিষ্ট কিছু উদ্ভিজ্জ খাবার, রাসায়নিক বা ওষুধের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।
মোলাস্কাম
এটি সাধারণত ভাইরাসের সংক্রমণে হয়, যা প্রায়শই শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। এগুলো তত ক্ষতিকারক নয়, কিন্তু শরীরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এর ফলে চুলকানি এবং ত্বকে শক্ত, উঁচু দাগ দেখা যেতে পারে। বগলে, হাঁটুর পেছনে বা কুঁচকিতে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল দাগ দেখা যায়। শারীরিক সংস্পর্শ বা তোয়ালের মাধ্যমে এটি ছড়াতে পারে।
হাত-পা ও মুখের রোগ
কাশি ও হাঁচির পাশাপাশি গৃহস্থালীর জিনিসপত্র যেমন- ছুরি-কাঁচির মাধ্যমে এ ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াতে পারে। ফ্লুর মত উপসর্গের পাশাপাশি মুখে ঘা এবং তালু বা পায়ের তলায় লাল ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। সাধারণত নিজে থেকেই এটি সেরে যায়।
ইমপেটিগো বা ছোঁয়াচে ঘা
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এ রোগ হয়। সাধারণত ত্বকের এমন অংশে এর সংক্রমণ হয়, যেখানে আগেই কোনো কারণে ক্ষত হয়ে ছিল।
মুখের উপর লাল ঘা, ফোসকা বা খসখসে ফোসকা দেখা দেয় এ রোগে। দেখতে গুরুতর মনে হতে পারে, তবে অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম দিয়েও সারিয়ে ফেলা যায়।
আরও খবর-
মাঙ্কিপক্স ছড়িয়েছে ১২ দেশে, ছড়াতে পারে আরও
ইউরোপে ‘সবচেয়ে বড়’ মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ, আক্রান্ত ১শ’ ছাড়িয়েছে