ক্যাটাগরি

রিয়ালের সামনে ‘ট্রেবল’ জয়ের চাপে লিভারপুল

প্যারিসের জাতীয় স্টেডিয়ামে শনিবার ইউরোপ সেরার লড়াইয়ে নামবে স্পেন ও ইংল্যান্ডের দুই জায়ান্ট। ম্যাচ শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ১টায়।  

গত মার্চ থেকে কোনো ম্যাচ হারেনি লিভারপুল। ইয়ুর্গেন ক্লপের দল পুরো মৌসুমে মাত্র তিনটি ম্যাচ হেরেছে। ঘরে তুলেছে লিগ কাপ ও এফএ কাপ।

প্রিমিয়ার লিগের শেষ রাউন্ডে তাদের শিরোপা স্বপ্ন ভেঙেছে ম্যানচেস্টার সিটির চেয়ে ১ পয়েন্টে পিছিয়ে থেকে। এবার রিয়ালের বিপক্ষে হেরে গেলে সেই হতাশা দ্বিগুণ হয়ে যাবে তাদের।

রিয়ালের জন্য পরিস্থিতি এর চেয়ে ভিন্ন হতে পারত না। মৌসুমের শুরুতে তাদেরকে ঘিরে প্রত্যাশা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু কার্লো আনচেলত্তির দল দুর্দান্ত ধারাবাহিকতায় লা লিগার শিরোপা জিতেছে সবাইকে অনেকটা পেছনে ফেলে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল তাদের জন্য নতুন কেনো মঞ্চ নয়। তবে এবার ফাইনালে ওঠার পথে ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য সব গল্প লিখে ইউরোপের ‘প্রত্যাবর্তনের রাজা’ হয়ে উঠেছে মাদ্রিদের দলটি।

এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে রিয়াল যত ম্যাচ হেরেছে, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তার চেয়ে কম হেরেছে লিভারপুল। তাই ফাইনালে ইংলিশ দলটিই জুয়াড়িদের হিসাবে ফেভারিট। তবে ‘অল রেড’ খ্যাত দলটির ওপরই প্যারিসের ফাইনালে চাপ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রিয়ালের জন্য মৌসুমটা কাটছে স্বপ্নের মতো। অথচ মৌসুমের শুরুতে তাদেরকে ঘিরে কৌতূহল ছিল তলানিতে। সেই দলটির সামনে এখন ‘ডাবল’ জয়ের হাতছানি, লা লিগা শিরোপা ঘরে তোলার পর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি হাত ছোঁয়া দূরত্বে। এ সব কিছুই সম্ভব হয়েছে মূলত করিম বেনজেমার কৃতিত্বে, ফরাসি তারকার অবিশ্বাস্য ফর্মের জন্য।  

চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এবার ১১ ম্যাচে ১৫ গোল করে বেনজেমা আছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় শীর্ষে। এই ১৫ গোলের ১০টিই আবার নকআউট পর্বে। তার এই পারফরম্যান্সই রিয়ালকে ৯ বছরে পঞ্চমবারের মতো ইউরোপের সেরার ট্রফি জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।

এবারের লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনিই। ৩২ ম্যাচে করেন ২৭ গোল, তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা খেলোয়াড়ের চেয়ে যা ৯টি বেশি। ২০২১-২২ মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৫ ম্যাচে তার গোল ৪৪টি, অ্যাসিস্ট ১৫টি। এবারের ব্যালন ডি’অর জয়ের বড় দাবিদার তিনি নির্দ্বিধায়।

৩৪ বছর বয়সী এই ফুটবলারের এভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসতে সময় লেগে গেছে অনেকটাই। ২০০৯ সালে রিয়ালে যোগ দেওয়ার পর থেকে সবসময়ই নীরবে নিজের কাজটা করে গেছেন। অধিকাংশ সময় ছিলেন ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর ছায়া হয়ে। ২০১৮ সালে পর্তুগিজ মহাতারকা চলে যাওয়ার পর বেনজেমা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন দলের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারী খেলোয়াড় হিসেবে আলাদা একটি জায়গা তৈরি করে নেন দলে।

চারটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল খেলে বেনজেমা গোল করেছেন কেবল একটি। সেই গোলটি লিভারপুলের বিপক্ষেই, ২০১৮ সালে। সেদিন তার গোলেই এগিয়ে গিয়েছিল রিয়াল। লিভারপুল গোলরক্ষক লরিস কারিয়ুসের মারাত্মক দুটি ভুল ও গ্যারেথ বেলের অসাধারণ ওভারহেড কিকে ম্যাচটি ৩-১ গোলে জিতেছিল রিয়াল। ঘরে তুলেছিল টানা তৃতীয় ও রেকর্ড ১৩তম শিরোপা। 

চার বছর আগের সেই ফাইনালের স্মৃতি বেনজেমা ও তার সতীর্থদের জন্য বাড়তি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে নিশ্চিতভাবেই। একই সঙ্গে এই মৌসুমে প্রতিযোগিতাটিতে রিয়ালের অসাধারণ সব প্রত্যাবর্তনের গল্প তাদের এই বিশ্বাস জুগিয়েছে যে, তারা হারতে পারে না। জিততে পারে যে কোনো অবস্থা থেকেই।

এবার নকআউট পর্বে পিএসজি, চেলসি ও ম্যানচেস্টার সিটি- তিন দলের বিপক্ষেই খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পরের ধাপে জায়গা করে নেয় রিয়াল।

শেষ ষোলোয় পিএসজির বিপক্ষে এক পর্যায়ে দুই লেগ মিলিয়ে রিয়াল ২-০ গোলে পিছিয়ে ছিল। এরপরই শেষ ৩০ মিনিটের সেই জাদুকরী অধ্যায়; বেনজেমার ১৭ মিনিটের হ্যাটট্রিকে বাজিমাত করে তারা।

এরপর চেলসির বিপক্ষে প্রথম লেগে বেনজেমার হ্যাটট্রিকে ৩-১ গোলে জয়ের পর ঘরের মাঠে খেই হারিয়ে রিয়াল পিছিয়ে পড়েছিল ৪-৩ গোলে। সেখান থেকে রদ্রিগো ও বেনজেমার গোলে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৪ গোলের অগ্রগামিতায় সেমি-ফাইনালে জায়গা করে নেয় তারা।

সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ছিল ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে অবিশ্বাস্য জয়। শেষ চারে দুই লেগের লড়াইয়ে ১৭৯ মিনিট পর্যন্ত ৫-৩ গোলে এগিয়ে থেকে ফাইনালের সুবাশ পাচ্ছিল সিটি। কিন্তু রিয়াল তো শেষের আগে শেষ হওয়ার নয়! সেটি তারা প্রমাণ করে আরেকবার।

অন্তিত মুহূর্তে দুই মিনিটে রদ্রিগোর দুই গোলে লড়াইয়ে সমতা টানার পর শেষ পর্যন্ত ৬-৫ গোলের অগ্রগামিতায় ফাইনালে ওঠে রিয়াল। ব্যবধান গড়ে দেওয়া গোলটি করেন সেই বেনজেমা, মৌসুম জুড়েই যিনি দলের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম।

ঘুরে দাঁড়ানোর সবগুলো গল্পই তারা লিখেছে চেনা আঙিনায়, সান্তিয়াগো বের্নবেউয়ে। মাঠটি তাই এমন একটি জায়গা হয়ে ওঠে, সমর্থকরা থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের মনে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে, সেখানে অলৌকিক সব কিছুই সম্ভব।

রিয়াল এবার ৩৫তম লা লিগা শিরোপা জিতে নিজেদেরই রেকর্ড সমৃদ্ধ করেছে মৌসুম শেষের প্রায় এক মাস বাকি থাকতে। ইউরোপ সেরার প্রতিযোগিতায় তারা এখন নিজেদের ১৭তম ফাইনালে খেলার দ্বারপ্রান্তে। আগেভাগে লিগ জেতায় খেলোয়াড়দের কিছুটা বিশ্রাম দেওয়ার সুযোগ কাজে লাগান কোচ আনচেলত্তি, যেন চোটের দুর্ভাবনা ছাড়াই তাদের ফাইনালে পাওয়া যায়। 

রিয়ালের প্রতিপক্ষ লিভারপুলকে প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা দৌড়ে ম্যানচেস্টার সিটির সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। চেলসির বিপক্ষে টাইব্রেকারে জিতে লিগ কাপ ও এফএ কাপ শিরোপা ঘরে তোলার পর প্রিমিয়ার লিগে সিটির পেছনে থেকে ভেস্তে যায় তাদের কোয়াড্রপল জয়ের আশা।   

লিভারপুলের তারকা ফরোয়ার্ড মোহামেদ সালাহ, ভার্জিল ফন ডাইক, ফাবিনিয়ো ও থিয়াগো গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চোটের সঙ্গে লড়ছেন। ফাইনালের জন্য তারা কতটা ফিট, সেই প্রশ্নও উঠছে।

সালাহ যদিও বারবার বলেছেন, তিনি তার ক্যারিয়ারের ‘সবচেয়ে বাজে’ মুহূর্তের বদলা নেবেন। ২০১৮ সালে তার অসাধারণ পারফরম্যান্সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠেছিল লিভারপুল। কিন্তু ফাইনালে সের্হিও রামোসের চ্যালেঞ্জে তিনি কাঁধে চোট পান ৩০ মিনিটে। চোট নিয়ে কিছুক্ষণ চালিয়ে যান খেলা। তবে একটু পর মাঠ থেকে উঠে যান কান্নাভেজা চোখে। লিভারপুল হেরে যায় ৩-১ গোলে। সেটির প্রতিশোধ এবার তিনি নিতে চান রিয়ালকে হারিয়ে।

কিন্তু প্রত্যাশার চাপ সামলে লিভারপুল ট্রফি জিততে পারবে তো? জবাব মিলবে আর কয়েক ঘণ্টার পরই।