আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জেলা পুলিশ ‘আত্মহত্যা রুখতে’ সচেনতামূলক সভার আয়োজন করে রোববার।
ওই সভায় ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বদরুল আলম মোল্লা জানান, ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত জেলায় আত্মহত্যা করা ৩৮ জনের মধ্যে পুরুষ ২১ এবং নারী ১৭ জন।
মৃতদের মধ্যে ২৩ জনেরই বয়স ১৬ থেকে ৩০ এর মধ্যে। এদের মধ্যে পুরুষ ১২ এবং নারী ১১। আর ৩০ এর ওপরে আছেন আটজন।
‘আত্মহত্যা একটি সাময়িক সমস্যার চিরস্থায়ী ব্যর্থতা’- এই প্রতিপাদ্যে শহরের একটি কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন ফেনীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন। এতে বিচারক, সংসদ সদস্য, অভিনয়শিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, ক্রিকেটারসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।
আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে গিয়ে পুলিশ জেনেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক কলহ ও বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে এসব ব্যক্তি নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পথে গেছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রেমে ব্যর্থতা, অভিমান ও ক্ষোভের কারণও উঠে এসেছে।
দাগনভূঞা থানার ওসি হাসান ইমাম জানান, সম্প্রতি উপজেলায় কয়েক শিক্ষার্থী, প্রবাসীর বধূ আত্মহত্যা করেছেন।
“এদের মধ্যে প্রেমঘটিত কারণে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী ও দশম শ্রেণির এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। অথচ এসব শিক্ষার্থীদের ভালোমন্দ বোঝার বয়সই হয়নি।”
ফেনীর প্রচুর মানুষ প্রবাসী জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বদরুল আলম মোল্লা বলেন, “কিছু প্রবাসীর স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে যান, যা একসময় পারিবারিক কলহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অশান্তি চরমে পৌঁছালে একসময় অনেকে আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আত্মহত্যা একটি অপরাধ। আত্মহত্যার পথ বেছে না নিয়ে সরাসরি পুলিশ কিংবা ৯৯৯ ফোন করে যে কেউ সহযোগিতা পেতে পারেন।”
ফেনীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মো. ইকবাল হোসেন ভূঞা বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে হাসপাতালের মর্গে নিয়মিত আত্মহত্যার মরদেহ আসছে। যাদের বেশিরভাগ শ্বাসরোধে আত্মহত্যা। হাসপাতালে গড়ে ১০ দিনে একটি আত্মহত্যার মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে হচ্ছে।”
ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক বেগম জেবুন্নেসা আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা ও আইন সম্পর্কে জানান।
দেশের আইনে ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু উল্লেখ করে এই বিচারক বলেন, “শুধু শিশুই নয়, দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিলে সেটি যদি আদালত থেকে প্রমাণিত হয় তাহলে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।”
পুলিশের উদ্দেশে এই বিচারক আরও বলেন, “আপনারা যারা পুলিশ বাহিনীতে কাজ করেন তারা কোনো আত্মহত্যার ঘটনাকে শুরুতে অপমৃত্যুর ঘটনা আকারে রেকর্ড না করে ৩০৫ ধারায় মামলা গ্রহণ করবেন।
“পরে তদন্তে ৩০৫ ধারা প্রমাণিত না হলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিবেন। শুরুতে অপমৃত্যুর মামলা দায়ের হলে আপনাদের তদন্তের মানসিকতা কমে যায়। আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে যদি আইন বিভাগ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যায় তাহলে সমাজে ইতিবাচক সাড়া পড়বে।”
আত্মহত্যার প্রবণতার কারণ সম্পর্কে কথা বলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জাকারিয়া সিদ্দিকী। তিনি বলেন, “আত্মহত্যা একটি মানসিক রোগ। বেশিরভাগ আত্মহত্যা ঘটে থাকে বিষণ্নতা, দারিদ্র্য, মাদক সেবন, বেকারত্ব ও সামাজিক নানা অস্থিরতা থেকে। ইদানিং বয়সন্ধিকালেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে।”
চলচ্চিত্র পরিচালক ও নির্মাতা এ এ হক অলিক আত্মহত্যা কোনো সমাধানের পথ নয় জানিয়ে নিজের জীবনকে ভালোবাসার এবং মা-বাবাসহ পরিবারের সবার কথা ভাবার পরামর্শ দেন।
“কোনো বিষয় নিয়ে বেশি হতাশা থাকলে ভালো ভালো চলচ্চিত্র দেখে বা বই পড়ে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
সভায় আরও বক্তব্য দেন অভিনেত্রী, মডেল ও প্রযোজক শমী কায়সার, চিত্রনায়িকা পূজা চৌধুরী রায়, জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য সাইফ উদ্দিন, কণ্ঠশিল্পী বেলী আফরোজ, নাজমা সুইটি, কৌতুক শিল্পী আরমান প্রমুখ।
সভায় ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তুজা, ওয়ানডের অধিনায়ক তামিম ইকবাল, টি-২০ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, ক্রিকেটার তাসকিন আহমেদ, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোহাম্মদ আশরাফুল, অভিনেত্রী ও মডেল মাসুমা আক্তার নাবিলা।
বক্তারা আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে জনসচেতনতামূলক কাজের পরিধি বাড়ানোর তাগিদ দেন। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আত্মহত্যা বন্ধে জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করার আহ্বান রাখেন।
সভা শেষে আত্মহত্যা রুখতে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখান হয়।
সভায় অতিথি ছিলেন ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাসদ (ইনু) সাধারণ সম্পাদক শিরীন আক্তার, ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী।
আরও ছিলেন স্কুল-কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আত্মহত্যাকারী পরিবারের সদস্য, তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।