পুলিশও বলছে, বেপরোয়া গতিতে ছুটার কারণেই বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কে উপজেলার বামরাইল এলাকায় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বাসটির ১০ যাত্রী প্রাণ হারায়। আহত হয় অন্তত ২০ জন।
আহতরা বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাদের অনেকেই কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। কয়েকজনের অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসক।
আহতদের একজন চল্লিশোর্ধ্ব মোহাম্মদ আনিস। তিনি পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া ইউনিয়নের রাজপাশা গ্রামের বাসিন্দা। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। যমুনা লাইন পরিবহনের বাসে করেই শনিবার রাতে বাড়ি যাচ্ছিলেন আনিস।
দুপুরে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাসটি গাবতলী থেকে ছেড়ে সাভার পার হওয়ার পর ইঞ্জিন বিকল হয়ে বসে যায়। দুই ঘণ্টা ধরে সেটি মেরামত করা হয়। তারপর যাত্রীরা ঠেলা দিয়ে সেটি চালু করেন।
“এই দুই ঘণ্টা সময় পুষিয়ে নেওয়ার জন্য চালক দ্রুতগতিতে বাসটি চালাচ্ছিলেন। রাস্তায় একের পর এক গাড়ি ওভারটেক করেছেন। একপর্যায়ে গাড়ি ওভারটেক করে কাটিয়ে উঠতে না পেরে গাছের সঙ্গে লেগে গেছে। তাড়াহুড়ার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কোনো গাড়িতেই লাগায় নাই। ফজরের পর পর।“
দুর্ঘটনার পর বেশ কিছুক্ষণ নিজের কোনো চেতন ছিল না বলে জানান আনিস। পাশ থেকে একজন ছিটকে এসে তার উপর পড়ে ছিলেন।
আনিস বলেন, “হঠাৎ দেখি, পেছনে একজন আমারে জড়াইয়া ধরে আছে। আমি তারে বললাম, ভাই আপনি এখানে কেন? তিনি বললেন, ভাই সব শেষ হয়ে গেছে। তখন আমার অনুভূতি হতে থাকে। আমি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাথা টের পেতে থাকি। গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গাড়ি মাঝখান থেকে ছিঁড়ে গেছে।”
“এরপর আমি আমার আশপাশে তাকাই। দেখি, লাশ পড়ে আছে। কারও হাত পড়ে আছে, কারও পা পড়ে আছে। কারও মাথার ঘিলু চলে গেছে। তখন দুইজন আমারে টেনে বের করল আর বলল, আপনে ওইদিকে তাকায়েন না। বাইরে চলেন।“
আনিস আরও বলেন, “কিছুক্ষণ পরে আমি স্ত্রীকে ফোন দেই। কথা বলতে পারছিলাম না। তারপরও বললাম, ভাল আছি। সে (স্ত্রী) তখন মোটরসাইকেলে করে উজিরপুরে যায়। আমারে নিয়ে সেখানকার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বরিশালে নিয়ে আসে।“
আনিস জানান, তার কাছে থাকা বেশ কিছু টাকা খোয়া গিয়েছে। তবে পথ খরচের যে টাকা ছিল সেটা আছে।
বরিশাল হাইওয়ে থানার ওসি শেখ বেল্লাল হোসেন বলেন, “বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণে চালক বাসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
“এ ছাড়া বাসের সামনের বাম পাশের চাকা ফাটা পাওয়া গেছে। চাকা ফাটার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কোনোকিছু নিশ্চিত নয়, তদন্তের পর সঠিক কারণ বলতে পারব।”
পুলিশ জানিয়েছে, যমুনা লাইন পরিবহনের বাসটি ঢাকা থেকে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া যাচ্ছিল। রোববার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে উজিরপুর উপজেলার বামরাইল এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে সেটি দুর্ঘটনায় পড়ে।
বামরাইল এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে বাসটি মহাসড়কের পাশে একটি গাছের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মারুফ জানান, দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। ২০ জনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর আরেকজনের মৃত্যু হয়।
নিহতদের মধ্যে সাত জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন মো. আরাফাত হোসেন (৯), মো. নজরুল ইসলাম (৩৫), মোসা. আনোয়ারা বেগম (২৩), মো. হালিম মিয়া (৩১), মো. সেন্টু মোল্লা (৫০). মো. রমজান হওলাদার (৩৫) এবং মাধব শীল (৪৫)। তাদের মধ্যে মাধব হাসপাতালে মারা গেছেন।
এ ঘটনা তদন্তে এরই মধ্যে বরিশাল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
রোববার দুপুরে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হচ্ছেন অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট রকিবুর রহমান খান। অপর সদস্যরা হচ্ছেন- বিআরটিএর উপ-পরিচালক এবং উজিরপুর থানার ওসি আর্শাদ আলী।
কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, আহতদের খরচ সরকার বহন করবে। আর যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন