ক্যাটাগরি

‘আত্মহত্যা’ হ্যাশট্যাগ নিষিদ্ধ করে কি লাভ হচ্ছে আদৌ?

কিন্তু এ বিষয়ে অনলাইন বা অফলাইনে মুক্ত
আলোচনার ক্ষেত্রে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা আদৌ যৌক্তিক কি না– উঠেছে সে প্রশ্ন।

আত্মহত্যা বিষয়েই দুই শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা
প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট আর্স টেকনিকা।

কায়লা উইলিয়ামস টিকটকে প্রায় ৮০ হাজার অনুসারীর
সঙ্গে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বললেও, প্ল্যাটফর্মটিতে তিনি কখনও
‘সুইসাইড’ শব্দটি ব্যবহার করেননি।

মহামারী শুরুর পর থেকে আত্মহত্যা প্রসঙ্গে
নিজের চিস্তা ভাবনা এবং মানসিক রোগীদের ওয়ার্ডে তার থাকা নিয়ে একাধিক ভিডিও পোস্ট করেছেন
ইংল্যান্ডের বার্কশায়ারের ২৬ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী।

এসব ভিডিও ক্লিপের কয়েকটি ‘হালকা’ ধরনের
হলেও, তার অন্যান্য ভিডিওর বিষয়বস্তু একেবারেই হালকা নয়। এর পরও টিকটকের অ্যালগরিদম
তার কনটেন্ট সেন্সর করবে, সেই ভয়ে ক্যামেরার সামনে একবারের জন্যেও ‘সুইসাইড’ শব্দটি
উচ্চারণ বা ক্যাপশনে লেখেননি উইলিয়ামস।

‘সুইসাইড’ শব্দের পরিবর্তে তিনি ‘আনঅ্যালাইভ’
শব্দটি ব্যবহার করছেন, যার বাংলা মানে দাঁড়াচ্ছে ‘অজীবিত’।

টিকটকে ‘আনঅ্যালাইভপ্লিজ’ হ্যাশট্যাগে ৯২
লাখ ভিউ রয়েছে। এ ছাড়া, ‘আনঅ্যালাইভিং’-এ ৬৬ লাখ, ‘আনঅ্যালাইভঅ্যাওয়েরনেস’-এ রয়েছে
আরও ২২ লাখ ভিউ।

টিকটকে বহুল ব্যবহৃত একটি হ্যাশট্যাগ হচ্ছে
‘সুইসাইডপ্রিভেনশন’। তবে, ‘সুইসাইড’ এবং ‘সুইসাইডঅ্যাওয়েরনেস’-এর মতো হ্যাশট্যাগ ব্যবহারকারী
সার্চ করলে সেটি পাওয়া যায় না। এর পরিবর্তে স্থানীয় হেল্পলাইনের নম্বর দেখায় মাধ্যমটি।

একটি আত্মহত্যার ভিডিও অ্যাপটিতে ছড়িয়ে পড়ার
বছরখানেক পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এই নীতিমালা চালু করেছে টিকটক। আর্স টেকনিকা বলছে,
টিকটক বিভিন্ন ‘মডারেশন ফিল্টার’-এর মাধ্যমে মৃত্যু, আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতি করার
মতো ভিডিও মুছে দেওয়ার কারণে প্ল্যাটফর্মটিতে এ বিষয়ে কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করেন ব্যবহারকারীরা।

‘আনঅ্যালাইভ’
শব্দটি প্রথম জনপ্রিয়তা পায় ২০১৩ সালে। তখন শব্দটি ‘আল্টিমেট স্পাইডারম্যান’-এর এক
পর্বে ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০২২ সালের গুগল সার্চে শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়।

টিকটকের
মাধ্যমে ‘আনঅ্যালাইভ’ শব্দটি টুইটার এবং রেডিটে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ইউটিউবাররাও আয় হারানোর
ভয়ে শব্দটি ব্যবহার করছেন। প্রসঙ্গ বিবেচনায় আত্মহত্যা, হত্যা বা মৃত্যুর মতো ঘটনা
বোঝায় শব্দটি।

টিকটকে
‘আনঅ্যালাইভ’ শব্দটি অনেক ক্ষেত্রেই হালকা ছলে ব্যবহৃত হয়। উইলিয়ামসের মতো ব্যবহারকারীরাও
স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে, নিজস্ব কমিউনিটি তৈরিতে এবং অ্যাপে থাকা ‘সাইনপোস্ট’ উৎসের
জন্য শব্দটি ব্যবহার করছেন।

‘আনঅ্যালাইভ’ শব্দটি ব্যবহার বেড়ে যাওয়া একটি প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে, প্রকাশ্যে
সবাই ‘আত্মহত্যা’ শব্দ না বললে কী হবে?

উইলিয়ামস
‘সুইসাইড’-এর বদলে ‘আনঅ্যালাইভ’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বলেন, “আমার মনে হয় এতে গুরুত্বপূর্ণ
একটি বিষয় নিয়ে রসিকতা করা হয়ে যাচ্ছে।”

ভিডিওর
গাম্ভীর্য কমাতে তিনি নিজেও ‘আনঅ্যালাইভ’ শব্দটি ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছেন উইলিয়ামস।
কিন্তু, “এটি আমার সঙ্গে যায় না। কারণ, এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের বাধা
ছাড়াই আমাদের কথা বলতে পারা উচিত,” যোগ করেন তিনি।

‘সুইসাইড’ শব্দটির ব্যবহারকে ঘিরে যে ‘স্টিগমা’
বা ভীতি ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আবহ বিরাজ করে, ‘আনঅ্যালাইভ’ শব্দটিও তাকে আরও জোরদার
করবে বলে উদ্বিগ্ন উইলিয়ামস।

“টিকটকের
সেন্সরশিপ এড়াতে আনঅ্যালাইভ শব্দটি কার্যকর হলেও, এর মানে হলো ‘সুইসাইড শব্দটিকে এখনও
ট্যাবু এবং ধরা-ছোঁয়া যাবে না এমন কোনো বিষয় হিসেবে দেখা হয়,”– বলেন তিনি।

ভিডিওতে
সেন্সরশিপ এড়াতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন শব্দ সরাসরি ব্যবহার না করে বিভিন্ন
বিকল্প শব্দ ব্যবহার করেন উইলিয়ামস।

উদাহরণস্বরূপ
‘ইটিং ডিসঅর্ডার’ শব্দটি বদলে সংক্ষেপে হয়ে যায় ‘ইডি’, ‘সেলফ-হার্ম’-এর বদলে ‘এসএইচ’,
‘ডিপ্রেশন’-এর বদলে ‘ডি3প্রেশন’। অন্যান্য ব্যবহারকারীরাও সাইটটিতে ‘সুয়ারস্লাইডেল’
এবং ‘সেলফএইচ_আরএম’-এর মতো হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছেন।

‘ইউনিভার্সিটি
অফ ব্রিস্টল’-এর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের একজন শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা পদ্মনাথন। ২০১৯ সালে
তিনি ভাষার ব্যবহার এবং আত্মহত্যা নিয়ে একটি জরিপ চালান। এতে আত্মহত্যার ঘটনায় প্রভাবিত
প্রায় তিন হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।

জরিপে
অংশগ্রহনকারীদেরকে তিনি বিষয়টি বর্ণনা করে এমন শব্দ ও বাক্যাংশের গ্রহনযোগ্যতা সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করেন। তিনি জানতে পারেন, ‘অ্যাটেম্পটেড সুইসাইড’, ‘টুক দেয়ার ওউন লাইফ’, ‘ডাইড
বাই সুইসাইড’ এবং ‘এন্ডেড দেয়ার লাইফ’– অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনার
জন্য সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য বাক্যাংশ হিসেবে বিবেচিত।

ওই
জরিপে অংশগ্রহনকারীদের বেশ কয়েকজন ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ
প্রকাশ করেছেন। একজন অংশগ্রহনকারী শব্দটি এড়িয়ে যাওয়াকে ‘বিপজ্জনক’ ও ‘বিচ্ছিন্ন’ হিসেবে
আখ্যা দিয়েছেন।

“আমার
ভাই আত্মহত্যা করেছে অথবা আমার বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। আমি মনে করি না শব্দটি
ব্যবহারে আমাদের ভয় পাওয়া উচিত।” –বলেছেন জরিপের আরেকজন অংশগ্রহনকারী।

“সামগ্রিকভাবে,
উত্তরদাতারা বাস্তবসম্মত, স্পষ্ট, বর্ণনামূলক, সাধারণত ব্যবহৃত, আবেগশূন্য, সম্মানজনক
এবং বৈধ হিসেবে বিবেচিত শর্তগুলোতে অগ্রাধিকারের ইঙ্গিত দিয়েছেন।” –বলছেন পদ্মনাথন।

‘আনঅ্যালাইভ’
শব্দটি ‘ভীতিকর’ হতে পারে কি না, সেটি নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। ২০১৮ সালের এক গবেষণা
উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, আত্মহত্যা নিয়ে আমাদের চিন্তা করার পদ্ধতির ক্ষেত্রে
এসব শব্দ প্রভাবিত করতে পারে এবং করবেও।

পদ্মনাথনের
করা গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন ‘ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখ’-এর একজন যোগাযোগ বিজ্ঞানী। সমীক্ষায়
অংশগ্রহনকারীদের আত্মহত্যা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন দেখানো হয়, যেগুলো প্রায় একই
ধরনের হলেও আত্মহত্যা বর্ণনা করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দগুলো ছিল ভিন্ন।

এসব প্রতিবেদনের কয়েকটিতে জার্মান শব্দ
‘সুইজিড’ ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া, অন্যান্য প্রতিবেদনে ‘ফ্রাইথড (স্বেচ্ছা মৃত্যু)’
এবং ‘সেলবসমর্দ (আত্মহনন)’-এর মতো আরও নেতিবাচক জার্মান শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, পাঠকরা প্রতিবেদনে ব্যবহৃত
যে শব্দ বা বাক্যাংশ পড়েছেন, পরবর্তীতে তাদের ওই শব্দ বা বাক্যাংশ ব্যবহারের সম্ভাবনাই
বেশি। আত্মহত্যা প্রসঙ্গে তাদের মনোভাব প্রভাবিত হয় প্রতিবেদনে ব্যবহৃত শব্দ বা বাক্যাংশ
থেকে।

এই ধরনের গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মনাথন
উল্লেখ করেছেন, আমাদের ব্যবহৃত শব্দই নির্ধারণ করে দিতে পারে ভুক্তভোগী সমস্যা সমাধানের
জন্য সাহায্য খুঁজছেন কি না।

এই প্রসঙ্গে আর্স টেকনিকা টিকটকের মতামত
জানতে চাইলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে, তাদের অফিশিয়াল ব্লগে বিষয়গুলো উল্লেখ রয়েছে।

“আমরা এমন কনটেন্টের অনুমতি দেইনা, যা আত্মহত্যা
ও নিজের ক্ষতির প্ররোচনা দেয়, প্রশংসা করে বা স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপন করে।” –নিজস্ব
ব্লগে লিখেছে টিকটক।

“আমরা
সেই সব ব্যক্তিকে সমর্থন করি, যারা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে সচেতনতা বাড়াতে চান, ভুক্তভোগী
কাউকে সাহায্য করতে চান ও আমাদের কমিউনিটি থেকে যারা সহায়তা খুঁজছেন।”