ক্যাটাগরি

পাপ পুণ্য: অন্তর্জ্বালা আর অনুশোচনার গল্প

মানুষ যখন অন্তর্জ্বালায় ভোগে, সেই বেদনা সে ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারে না। তাই ছবি দেখে নির্দ্বিধায় মনে হবে বেদনার সব কথা মানুষ বলে না! মনে হবে মানুষ চলে যায়, কিন্তু তার গল্প বেঁচে থাকে। মনে হতে পারে পরিচালক সিনেমার সব গল্প খোলাসা করে দিতে চাননি। মনে হতে পারে সিনেমার নাম পাপ পুণ্য তাহলে কেন?

গিয়াস উদ্দীন সেলিমের চতুর্থ (মনপুরা, স্বপ্নজাল ও গুণিন) সিনেমা পাপ পুণ্য মুক্তি পেয়েছে ২০ মে।

চঞ্চল চৌধুরী এলাকার চেয়ারম্যান। কোনো রকম কপটতা, চাতুরি বা ছলনা নেই তার। সে চায় প্রকৃতভাবে জনগণের সেবা করতে। এমপি মামুনুর রশীদের ডান হাত সে। বাম হাত গাওসুল আলম শাওন। শাওনের এক আত্মীয় মনির খান শিমুল গ্রামের এক মেয়েকে ধর্ষণ করলে চঞ্চল ধর্ষককে শাস্তি দিতে চায়। শাওনের অনুগত পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর ফজলুর রহমান বাবু আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার দাবি করে ধর্ষককে বাঁচাতে চায়। চঞ্চল চৌধুরীর কারণে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও শাওনের লোকরা কোপাতে আসে চঞ্চলকে। চঞ্চলের বডিগার্ড কাম ‘ভাইস্তা’ (সারা সিনেমায় চঞ্চলকে কাকা বলেই ডাকে!) সিয়াম পিস্তল বের করে গুলি ছুড়লে শাওনের লোকরা পালিয়ে যায়। সৎ ও পুণ্যবান চেয়ারম্যান চঞ্চল চৌধুরীর পুণ্য কি এতে খোয়া যায় একটুও?

যদিও বাউল রতনের জমি যা সরকার আয়ত্তে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলে এবং শাওন সেটা কেড়ে নিতে চাইলেও চঞ্চল রতনের পক্ষে দাঁড়ায়। চঞ্চল আর শাওনের দ্বন্দ্ব আরও বাড়ে, এমপি মামুনুর রশীদও এই দ্বন্দ্ব মেটাতে পারেন না।

অন্যদিকে ‘ভাইস্তা’ সিয়াম (সিনেমায় নাম আল আমিন) ভালোবাসে চঞ্চল চৌধুরীর মেয়ে শাহনাজ সুমী ওরফে সাথীকে। এই প্রেম টের পায় সিয়ামের মা আফসানা মিমি। মিমি চঞ্চলের বাসায় কাজ করেন। তিনি ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে চঞ্চলের স্ত্রী নাজনীন চুমকির কাছে অনুরোধ করেন। চঞ্চল চৌধুরী তাতে রাজি হন না। কিন্তু সিয়াম আর সুমীর প্রেমে আরও বেশি জোয়ার এলে সিয়ামের মা চঞ্চলের স্ত্রীকে জানিয়ে দেন। নাজনীন চুমকি চঞ্চল চৌধুরীকে জানালে তার ভাবনার জগতে পরিবর্তন আসে। সে সিয়ামকে বিদেশ পাঠাতে ঢাকা নিয়ে আসে। ট্রেনে করে ফেরার পথে চঞ্চল জড়িয়ে যায় রতন হত্যা মামলায়।

চঞ্চল জেলে যাওয়ার পর ছবির গল্পের নাটকীয়তা আরও বাড়ে। জানা যায় বোমা ফাটানো এক তথ্য। পত্রিকায় আসে সিয়ামের মৃত্যুর খবর। একা একা সিয়ামের মা মিমি জেলখানায় দেখা করতে যায় চঞ্চল চৌধুরীর সাথে। সে সিয়ামের মৃত্যুর খবর জানিয়ে বলে সিয়াম চঞ্চল চৌধুরীর ছেলে! চঞ্চল চৌধুরী চলে যায় এক ঘোর ও অন্তর্জ্বালার জগতে। সে জেলখানায় তার স্ত্রী ও কন্যার সাথে দেখা করতে চায় না। পরে সে দেখা করতে চায় সিয়ামের মা আফসানা মিমির সাথে। সাজানো বিচারে চঞ্চলের ফাঁসি হয়, কিন্তু জানা যায় বিদেশে পাঠানোর আগেই চঞ্চল সিয়ামকে হত্যা করেছে!

এই সিনেমা দেখলে কিছু প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে মনে। দেখে জানা যায় না কে বা কারা কীভাবে হত্যা করেছে বাউল রতনকে, অথচ এই হত্যা মামলায় চঞ্চলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়! ফেরার পথে ট্রেনে দুজন অচেনা লোক একটা ট্রাংক রেখে গেলে চঞ্চল সেটা নিজ দায়িত্বে বগিতে তোলে। একজন চেয়ারম্যান যার শত্রু আছে তার একা একা ফেরাটা কি স্বাভাবিক? কীভাবে সে অচেনা লোকের ট্রাংক নিজ দায়িত্বে নেয়? আবার সিয়ামকে হোটেলে খুন করে চঞ্চল কীভাবে তাকে ব্যাগে ভরে নদীতে ফেলে দিল? সিয়ামের শরীর কি ব্যাগে ঢোকানো সম্ভব ছিল? নাকি টুকরো টুকরো করে তার দেহ ব্যাগে ঢোকানো হয়েছিল? একা একা সেটা সম্ভব? ফাঁসির আসামিকে যম টুপি কখন পরানো হয়? ফাঁসির মঞ্চে নাকি কয়েদী যে রুমে থাকে সেখান থেকে পরিয়ে তাকে মঞ্চে নেওয়া হয়? জেলে কয়েদীদের নির্দিষ্ট পোশাক থাকে, জেলে চঞ্চল চৌধুরীকে কী সবসময কয়েদীর পোশাকে দেখা গেছে? ফাঁসির রায় দেওয়ার সময় বিচারক সাধারণত স্বাক্ষরের পর কলমের মুখটা ভাঙেন যেন এই কলম দিয়ে আর কোনো ফাঁসির রায় লিখতে না হয়- যা এই সিনেমায় নেই। নেই চঞ্চলের জীবনের সেই গোপন গল্পের পরবর্তী ধাপ যেখানে আফসানা মিমি, নাজনীন চুমকি আর শাহনাজ সুমির মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বটা জমে উঠতে পারতো!

তারপরও এই সিনেমা গিয়াস উদ্দীন সেলিমের আগেরগুলোর চেয়ে ব্যতিক্রম। সিনেমাজুড়ে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সুন্দর অভিব্যক্তি ছিল চঞ্চলের। চঞ্চল চৌধুরী ছাড়াও মামুনুর রশীদ, ফারজানা চুমকি, শাহনাজ সুমি, গাউসুল আলম শাওন সুন্দর অভিনয় করেছেন। সিয়ামের অভিনয় মনে রাখার মতো। মৃধা বনাম মৃধার যে সিয়াম, শান সিনেমার সিয়াম তার চেয়ে ঢের আলাদা। শান সিনেমার যে সিয়াম তার থেকে অনেক বাস্তব পাপ পুণ্য’র সিয়াম। ভিন্ন প্রেক্ষিতে দিন রাতের আলোর সঙ্গে আলোর ব্যবহার দেখে মনে হতে পারে বাড়তি আলোক সংযোজন না করেই এই ছবির শুটিং করা হয়েছে, যেটি প্রসংসা পেতেই পারে। গিয়াস উদ্দীন সেলিমের সিনেমায় প্রকৃতি দেখানোর আয়োজন থাকে, যা এতেও ভরপুর আছে। গিয়াসউদ্দীন সেলিমের সিনেমায় মনকাড়া কিছু গান থাকবে এটা মনপুরা থেকেই হয়ত দর্শক প্রত্যাশা। এই সিনেমার গানগুলোও জনপ্রিয় হতে পারে।

সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন চৌধুরী। ইমন নিজে আতিয়া আনিসার সাথে একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন যার শিরোনাম-‘তোর সাথে নামলামরে পথে’। গানের কথা লিখেছেন ইশতিয়াক আহমেদ । ছবিতে কবিয়াল বিজয় সরকারের লেখা, সুর করা ও একদা তার কণ্ঠে জনপ্রিয় হওয়া ‘চোখ গেল পাখি কেন তুই ডাকিসরে’ গানটি ছবির জন্য বগা তালেবকে দিয়ে গাওয়ানো হয়েছে। বিজয় সরকারের সুরেলা দীর্ঘশ্বাস তালেবের গানে কতটা আছে সেটা অনুল্লেখ থাক। দর্শক এবং শ্রোতাদের উপরেই তোলা থাক এই গানের বিচারের ভার!

বাংলা সিনেমার এই ধারা অব্যাহত থাকুক। গিয়াসউদ্দীন সেলিমের পাপ পুণ্য সিনেমার জন্য শুভকামনা রইলো।